লোকটার পরিধানে একটা লুঙ্গি, গায়ে একটা কোর্তা। মাথায় একটা মুসলমানী টুপি।
সুব্রত মুহূর্তে সমস্ত পরিস্থিতিটা মনে মনে একবার পর্যালোচনা করে নিল। সুব্রত তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে একবার চারিধারে পরীক্ষা করে নিল। আশেপাশে আর কোন দ্বিতীয় প্রাণী নজরে পড়ে না। লোকটা চোখ মেলে বসে থাকলেও সজাগ নয়। এক্ষেত্রে একমাত্র উপায় চকিতে লোকটাকে পশ্চাৎ থেকে আক্রমণ করে ঘায়েল করা।
মনে মনে তাই ও ঠিক করে ফেললে। লোকটাকে আক্রমণই করবে-ও।
বাবলু চাপা গলায় বলল, ওই মিঞা বসে আছে দাদা। আপনি ওকে যদি ধরতে পারেন, তবে সেই ফাঁকে আমি ঘরের ভিতর থেকে রাণুদিকে খুঁজে আনতে পারি।
সুব্রত মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানালো, তাই হবে।
সুব্রত চকিতে গিয়ে মিঞাকে পশ্চাৎ থেকে দুহাতে জাপটে ধরল সজোরে। অতর্কিতে সহসা এমনভাবে আক্রান্ত হয়ে লোকটা ভয়ানক চমকে গিয়েছিল এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। কিন্তু সে ক্ষণমাত্র। পরক্ষণেই লোকটা প্রবল এক ঝাপটা দিয়ে গায়ের সমগ্র শক্তি প্রয়োগ করে নিজেকে সুব্রতর দৃঢ় আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করে নেওয়ার চেষ্টা করল। লোকটার গায়ে প্রচণ্ড শক্তি। বাবলু ততক্ষণে এক দৌড়ে সামনের ঘরের ভেজানো দরজাটা ঠেলে ঘরের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করল।
ছোট অপরিসর ঘরটা।
ঘরের এক কোণে একটা কাঠের বাক্সের ওপরে একটা ধূম্রমলিন হ্যারিকেনবাতি টিটি করে আলোর চাইতে বেশি ধূমোদগীরণ করছে। ঘরের মাঝখানে একটা দড়ির খাটিয়ার ওপর হাত-পা বাঁধা অবস্থায় রাণু পড়ে আছে। ঘরের ম্লান আলোকে বাবলু এসে রাণুর সামনে দাঁড়ালো। রাণু বাবলুকে দেখে উঠে বসতে চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। বাঁধা হাত পা নিয়ে আবার হেলে পড়ে গেল।
বাবলু চকিতে রাণুর ওপর ঝুঁকে পড়ে তাড়াতাড়ি রাণুর হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিতে লাগল।
রাণু বাবলুর ব্যবহারে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিল। সে বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখে বাবলুর দিকে চেয়ে দেখছিল।
বাঁধন খোলা হয়ে গেলে রাণু খাটিয়ার ওপর উঠে বসল।
বাবলু ডাকল, রাণুদি, শীঘ্র পালিয়ে চল!
রাণু খাটিয়ার ওপর থেকে নীচে নেমে দাঁড়াল।
ওদিকে ততক্ষণ সুব্রত লোকটাকে ঘায়েল করে তার বুকের ওপরে চেপে বসেছে। লোকটা সুব্রতকে তার নিজের শরীরের উপর থেকে ফেলে দেওয়ার জন্য প্রবল চেষ্টা করছে।
রাণুর হাত ধরে একপ্রকার টানতে টানতে বাবলু ওই ঘরে এসে প্রবেশ করল।
সুব্রত লোকটাকে কায়দা করে আনলেও নিজে তখন প্রবলভাবে হাঁপাচ্ছে। বাবলু রাণুর হাত ধরে থমকে যুদ্ধরত সুব্রতর দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। ঘরের চারপাশ একবার চকিতে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলিয়ে দেখে নিল। সহসা ওর নজরে পড়ল ঘরের এক কোণে একটা লোহার ডাণ্ডা পড়ে। আছে। ছুটে গিয়ে বাবলু ডাণ্ডাটা হাতে তুলে নিল এবং ডাণ্ডাটা দিয়ে বসাল এক আঘাত। লোকটা একটা আর্তনাদ করে উঠল এবং দেখতে দেখতে মুষ্টি তার শিথিল হয়ে গেল।
লোকটা জ্ঞান হারাল।
সুব্রত উঠে দাঁড়াল এবং অদূরে দণ্ডায়মান বাবলুর মুখের দিকে তাকাল। অজস্র কৃতজ্ঞতায় সুব্রতর চোখের দৃষ্টি তখন অশ্রুসজল হয়ে উঠেছে। সুব্রত দুহাত বাড়িয়ে গভীর স্নেহে বাবলুকে বুকের ওপরে টেনে নিল। কৃতজ্ঞতায় তার কণ্ঠস্বরও বুঝি তখন রুদ্ধ হয়ে গেছে।
কিন্তু বাবলু বাধা দিল, দাদা, শীঘ্র এখান থেকে পালিয়ে চলুন! কেউ এসে পড়তে পারে!
২১. বুকভরা উৎকণ্ঠায় অমিয়াদি
বুকভরা উৎকণ্ঠায় অমিয়াদি ও ডাঃ বোস তখনও বাইরের ঘরের দুখানা সোফায় মুখোমুখি হয়ে জেগে বসেছিলেন।
রাত্রি তখন সাড়ে তিনটে বেজে গেছে।
সুব্রত দুহাতে রাণু ও বাবলু দুজনকে ধরে ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল, অমিয়াদি!
কে? একসঙ্গে দুজনেই চমকে সামনের দিকে চোখ তুলে তাকালো।
এই নিন অমিয়াদি, আপনাদের রাণু!
অমিয়াদি আকুলভাবে মেয়ের দিকে দুহাত প্রসারিত করে দিলেন। রাণু একপ্রকার ছুটে এসেই মায়ের বুকের ওপরেই ঝাঁপিয়ে পড়ল। মা, মা-মণি! অমিয়াদির চোখের কোল দুটি অশ্রুসজল হয়ে উঠল।
ডাঃ বোস প্রশ্ন করলেন, কেমন করে কোথায় ওকে খুঁজে পেলেন সুব্রতবাবু? আপনাকে ধন্যবাদ দিয়ে আজ আর ছোট করবো না!
ধন্যবাদ যদি দিতেই হয় ডাঃ বোস, তবে আমার বোন বাবলুকে দিন। বাবলু না থাকলে আজ রাণুকে উদ্ধার করা কোনমতেই সম্ভব হত না।
ডাঃ বোস এগিয়ে এসে বাবলুর মাথার ওপরে শুধু গভীর স্নেহে একখানা হাত রাখলেন, কী আর বলবেন তিনি! সকল ভাষা আজ যেন তার কৃতজ্ঞতার বন্যায় ভেসে গেছে।
অনেক রাত হয়েছে। ওদের শুতে নিয়ে যান অমিয়াদি। সুব্রত বললে, এখন আমি যাই, কাল সকালে এসে সব কথা খুলে বলব। হাতে আমার অনেক কাজ বাকি।
ডাঃ বোস বললেন, এই শেষরাত্রে আর আপনি নাই বা গেলেন সুব্রতবাবু। আপনার শরীরের ওপর দিয়ে তো কম ধকল যায়নি। বাকি রাতটুকু এখানে শুয়েই বিশ্রাম করে নিন।
অমিয়াদিও বললেন, সেই ভাল সুব্রত। আজ রাত্রে কোথায় যেও না।
গুরু পরিশ্রমে সুব্রতর শরীরও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। আপাতত খানিকটা বিশ্রামের বিশেষ প্রয়োজন। তাই সে রাজী হয়ে গেল।
বাবলু আর রাণুকে শুইয়ে সুব্রতর বিছানা পেতে দিয়ে গেলেন অমিয়াদি। সুব্রত শয্যার ওপরে গা এলিয়ে দিল।
***
সকালবেলা হাত-মুখ ধুয়ে চা খেয়ে সুব্রত বের হতে যাবে, সহসা বাবলু পিছন থেকে সুব্রতকে ডাকল, দাদা!
সুব্রত ফিরে দাঁড়াল। সামনেই একান্ত কুণ্ঠিতভাবে বাবলু দাঁড়িয়ে।