সুব্রত হাতের টর্চ-বাতি নিভিয়ে নিঃশব্দে অন্ধকারে বাবলুর প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে রইল। কতকাল আগে কলকাতার এই শহরের উপরে এইসব বাড়ির তৈরি হয়েছিল কে জানে!
বড় বড় সব বাড়ি। বেশির ভাগই দোতলা-তেতলা। খালি পড়ে আছে। একতলাগুলো গুদামঘর হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
অন্ধকারে কয়েকটা মশা কানের কাছে ভন করছে। হঠাৎ পায়ের উপর দিয়ে প্রকাণ্ড একটা ইদুর সড়সড় করে চলে গেল।
সুব্রত শশব্যস্ত সরে দাঁড়াল একটু। অতি আধুনিক শহরের সঙ্গে এই সংকীর্ণ অন্ধকার গলিপথের যেন কোন সম্পর্কই নেই।
সুব্রতর মনের মধ্যে অনেক কথাই একসঙ্গে ঘুরপাক খেয়ে খেয়ে ফিরছিল। মাত্র চারদিনের মধ্যে ঘটনার সংঘাতে কোথায় ভেসে এসেছে।
মিঃ সরকারের মৃত্যু তদন্তের ব্যাপারে সব কাজই এখনও বাকি। সমস্ত ব্যাপারটা ভেবে দেখবারও এখনও পর্যন্ত সময় পায়নি। কিরীটাই বা কতদূর কী করল কে জানে?
আজ এই কদিনে যেসব ঘটনাগুলো ঘটে গেল, এগুলো কিরীটী জানতে পারলে হয়ত তদন্তের ব্যাপারে অনেকখানি আলোর সন্ধান দিতে পারত। তারপর এই মেয়েটি। দুঃখ ধান্ধার মধ্যে এই অল্প বয়সে কী টানাপোড়েনই বেচারীর চলেছে! আশ্চর্য স্বভাব। যে রাণু তাকে অনায়াসেই বিপদের মুখে ঠেলে দিতে এতটুকুও পশ্চাৎপদ হয়নি, তারই জন্য ও কতখানি ব্যাকুল হয়েই না এই বিপদের মধ্যে ছুটে এল। এতটুকু দ্বিধাবোধও করলে না।
হঠাৎ এমন সময় ও বাবলুর ডাকে চমকে উঠল।
দাদা!
উঁ? সুব্রত জবাব দিল।
দাদা, সমস্ত বাড়িটাই আমি ঘুরে দেখে এলাম। কিন্তু ওরা কেউ নেই। একমাত্র অবু আর বঙ্কা একটা ঘরের মধ্যে বসে বসে কথা বলছে। এখানে নিশ্চয়ই ওরা রাণুদিকে নিয়ে আসেনি।
তবে?
মিঞার ওখানে এখন যেতে হবে আমাদের। আমার মনে হয়, ওরা নিশ্চয়ই রাণুদিকে ধরে সেখানে নিয়ে গেছে।
বাবলু আবার জানালাপথে নীচে লাফিয়ে পড়ল, চলুন মিঞার ওখানে যাওয়া যাক।
সে কোথায়?
বড় রাস্তার ওপরেই, অল্প দূরে।
চল।
ওরা দুজনে আবার গলিপথ থেকে বের হয়ে বড় রাস্তার উপরে এসে পড়ল। বড় রাস্তার উপর দিয়ে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে আর একটা সরু গলির মধ্যে প্রবেশ করল।
এ গলিপথটা আগেকার চাইতে সামান্য একটু প্রশস্ত বটে, তবে এখানে আলোর কোন সংস্পর্শ নেই। অন্ধকার।
কিছুটা পথ এগিয়ে গিয়ে বাবলু একটা দোতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল।
দাদা, এই বাড়িতে মিঞা থাকে। আলো জ্বেলে দেখুন, সামনে একটা ছোট পাঁচিল।
সুব্রত বাবলুর কথামত টর্চবাতি জ্বেলে দেখলে, সামনেই প্রায় হাত আড়াই উঁচু একটা পুরাতন প্রাচীর। প্রাচীরের গায়েই একতলার ছাদ। ছাদের ওপরে একটা গঙ্গাজলের ট্যাঙ্ক দেখা যাচ্ছে।
আলোটা নিভিয়ে ফেলুন দাদা। ঐ পাঁচিলের ওপরে উঠে জলের ট্যাঙ্কটার ওপর দাঁড়ালেই দেখতে পাবেন বারান্দা। বারান্দাটায় লাফিয়ে পড়বেন। সেটা দোতলার বারান্দা। বারান্দা দিয়ে একটু এগোলেই দেখবেন নীচে নামবার কাঠের সিঁড়ি। সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এসে আগে দরজাটা খুলে দিন।
সুব্রত নিমেষে প্রস্তুত হয়ে নিল মালকোচা এঁটে। তারপর অন্ধকারে বার দুই লাফিয়ে চেষ্টা করতেই তৃতীয়বারে ও পাঁচিল ধরে ফেলল। নিমেষে ও হাতের ওপর ব্যালেন্স করে পাঁচিলের ওপর উঠে বসল। পাঁচিলের ওপর থেকে ট্যাঙ্কের ওপর উঠতে বেশি বেগ পেতে হল না।
হ্যাঁ, ঠিক সামনেই সরু একটা ফালিমত বারান্দা দেখা যাচ্ছে বটে।
অতি সন্তর্পণে লাফিয়ে সুব্রত বারান্দায় গিয়ে পড়ল।
বারান্দায় কোন আলো নেই, অন্ধকার। একটা খালি ঘর, তার দরজা খোলা হাঁ-হাঁ করছে। সুব্রত কিছুক্ষণ কান পেতে শোনবার চেষ্টা করল। কিন্তু কোথাও কোন সাড়াশব্দ নেই। হঠাৎ যেন মনে হল অন্ধকারে কোথা থেকে একটা চাপা কান্নার শব্দ আসছে। সুব্রত থমকে দাঁড়াল, কে কাঁদে না! হ্যাঁ, তাই তো। কার কান্নার শব্দ? এমন সময় একটা চাপা গর্জন শোনা গেল, এই থাম হুঁড়ি!
সুব্রত চমকে উঠল। কিন্তু ঠিক ঠাহর করে এবং তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারপাশ দেখেও বুঝতে পারল কোথা থেকে শব্দটা আসছে।
আর দেরি নয়। বাবলু একা গলিপথে নীচে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ছেলেমানুষ।
ও বারান্দা দিয়ে আর একটু এগিয়ে গেল। আকাশের বুকে তখন সরু এক ফালি চাঁদ উঠেছে।
চাঁদের ক্ষীণ আলোয় এই ভাঙা পুরাতন বাড়ির খানিকটা যেন ফ্যাকাসে করুণ দেখায়।
সেই মৃদু আলোয় সুব্রত দেখতে পেল, সামনেই একটা ভাঙা পুরাতন কাঠের সিঁড়ি। নীচে, একটা সংকীর্ণ উঠান।
উঠানটাও ক্ষীণ চালোকে অস্পষ্ট দেখা যায়।
সুব্রত আর দেরি না করে সিঁড়ি বেয়ে সন্তর্পণে নেমে এল। উঠানের ওপাশে একটা মাত্র ঘর। ঘরের দরজাটা খোলা। আলো হাতে ঘরের মধ্যে ঢুকতেই ও দেখলে, ঘরের মধ্যে একটা খিল আঁটা দরজা। আন্দাজেই ও বুঝতে পারল, এটাই ও-বাড়ি থেকে বাইরে বেরুবার রাস্তা।
সুব্রত খিলটা খুলে ফেলতেই দরজাটা ঠেলে বাবলু ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল। সুব্রত চাপা গলায় বাবলুকে বললে, কার যেন চাপা কান্না শুনতে পেলাম বাবলু।
বাবলু জবাব দিল চাপা গলায়, ঠিক, তাহলে তারা এখানেই রাণুদিকে নিয়ে এসেছে। এবারে আমার পিছনে পিছনে আসুন। বাবলু এগিয়ে চলল। উঠানটা পার হতেই আর একটা দরজা। এ দরজাটা ভেজানোই ছিল, ঠেলা দিতেই খুলে গেল। সামনেই একটা ঘর। ঘরের মাঝখানে একটা কাঠের টেবিলের ওপরে একটা ধূম্রমলিন হ্যারিকেনবাতি জ্বলছে।
সেই টেবিলের সামনে একটা টুলের ওপরে পিছন ফিরে বসে একটা লম্বা-চওড়া লোক আপন মনে বিড়ি ফুঁকছে।