কোথায় গিয়েছিলে?
শিশির তখন সংক্ষেপে আগাগোড়া সমগ্র ব্যাপারটি ডাঃ বোসকে বলে বললে, আমি এখুনি সুব্রতবাবুকে ফোন করতে চাই। আপনার ফোন কোথায়?
ডাঃ বোস শিশিরের মুখে সমস্ত ঘটনা শুনে যেন হতবাক হয়ে গেছেন। কোন মতে হাত তুলে ঘরের কোণে ফোনটা দেখিয়ে দেন।
ওদিকে সুব্রত শিশিরের মুখে ফোনে সংবাদ পেয়ে অতিমাত্রায় চঞ্চল হয়ে বললে, আমি এখনি আসছি। তুমি অপেক্ষা কর।
বাড়ির মধ্যে সংবাদ পৌছাল। হন্তদন্ত হয়ে অমিয়াদি বাইরের ঘরে এসে ঢুকলেন, এসব কি শুনছি! রাণুকে নাকি কারা ধরে নিয়ে গেছে?
ডাঃ বোস তার মেয়ে রাণুর হিংসাপরায়ণ স্বভাবের সঙ্গে যথেষ্ট পরিচিত ছিলেন। শিশিরের মুখে সমস্ত ব্যাপার শুনে মেয়ের জন্য যেমন তিনি ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন, মেয়ের কুৎসিত ব্যবহারে লজ্জাও পেয়েছিলেন ঠিক ততোধিক।
বাবলু তখন একটা সোফার ওপরে বসে হাতে মুখ ঢেকে ফুলে ফুলে কাঁদছিল।
স্ত্রীকে সংক্ষেপে সমগ্র ব্যাপারটা খুলে বলে ডাঃ বোস বললেন, রাণু যে আমাদের এতখানি খারাপ হয়েছে তা কোনদিনই ভাবিনি, অমিয়া!
অমিয়াদি স্বামীর মুখে সমগ্র ব্যাপার শুনে বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। তার মেয়ের চিন্তার চেয়েও সুব্রতর কাছে মুখ দেখাবেন কী করে, সেই আসন্ন লজ্জাকর পরিস্থিতির চিন্তায় মূক হয়ে গেলেন।
অল্পক্ষণ পরেই সুব্রতর গাড়ি এসে বাইরে দাঁড়াল। ঝড়ের মতই দ্রুতপদে এসে সুব্রত ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল। সুব্রতকে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করতে দেখেই বাবলু ছুটে এসে সুব্রতকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললে। বললে, রাণুদিকে ধরে দিয়ে গেছে দাদা মানকে, গোবরা! কী হবে?
কেঁদো না বাবলু, এখুনি রাণুকে আমরা ফিরিয়ে নিয়ে আসব।
আমিও আপনার সঙ্গে যাব দাদা। আমি তাদের সবকিছু জানি। কোথায় তারা রাণুদিকে ধরে নিয়ে গিয়ে রাখবে তা আমি জানি। হয় উত্তরের ঘরে, নয়তো পুরাতন বাড়ির নীচে তলায়। কয়েকদিন আমাকে তারা সে-বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। মিঞা সেখানে থাকে নিশ্চয়ই। মিঞার ঘরেই রাণুদিকে তারা আটকে রাখবে।
২০. বাবলুর কথা শুনে সুব্রত চিন্তিত
বাবলুর কথা শুনে সুব্রত চিন্তিত হয়ে উঠল। যে উপায়ে তোক রাণুকে শত্রুর কবল থেকে উদ্ধার করতে হবে। কিন্তু তাড়াতাড়ি করলে কোন কাজই হবে না। ভেবেচিন্তে অগ্রসর হতে হবে। বাবলুর কথাগুলো ভেবে দেখবার মত। যদি সেই কথা অনুসারেই কাজ করতে হয় তবে বাবলুর নির্দিষ্ট পথ ধরেই অগ্রসর হতে হবে। বাবলুকে সঙ্গে নিয়ে গেলে হয়তো সহজেই সব জায়গাগুলো খুঁজে দেখতে পারবে। সুব্রত বাবলুর দিকে তাকিয়ে বললে, সেই ভাল বাবলু, চল তুমি আমার সঙ্গে। তুমি ওদের আড্ডার সব গলি-খুঁজি জানো।
বাবলু চটপট প্রস্তুত হয়ে নিল।
শিশিরের কপাল অনেকখানি কেটে গিয়েছিল। ডাঃ বোসের হাতে শিশিরের শুশ্রুষার ভার তুলে দিয়ে এবং অমিয়াদি ও ডাঃ বোসকে রাণুর সম্বন্ধে চিন্তা না করতে বলে সুব্রত বাবলুর হাত ধরে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।
রাস্তার ওপরই সুব্রতর ডিমলার গাড়িখানা অপেক্ষা করছিল। বাবলুর হাত ধরে গাড়িতে উঠে বসে ড্রাইভারকে চিৎপুরের দিকে দ্রুত গাড়ি চালাতে বললে সুব্রত।
গাড়ি ছুটে চলল।
চিৎপুর রোডে অবস্থিত সেই বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভারকে সতর্ক করে সুব্রত বাবলুর হাত ধরে গাড়ি থেকে নামল। রাত্রি তখন বোধ করি প্রায় বারোটা। চিৎপুরের রাস্তাটা তখন একেবারে নির্জন হয়ে যায়নি। মানুষের চলাচল তখনও বেশ আছে। দুএকটা খালি। মোষের গাড়ি পিচের সড়কের ওপর দিয়ে ঘড়ঘড় শব্দ করতে করতে চলে গেল।
বাবলু সুব্রতর হাত ধরে এগুচ্ছিল। বাড়িটার কাছাকাছি এসে চাপা স্বরে বললে, দাদা, এ দরজা দিয়ে ঢুকবো না। ওদিককার সরু একটা গলির মধ্যে দিয়ে গেলে বাড়িতে ঢুকবার আরও একটা দরজা আছে। সেটা দিয়েই বাড়িতে ঢুকব।
বেশ তাই চল। আমি তো চিনি না, তুমি রাস্তাটা দেখিয়ে নিয়ে চল।
বাবলু চাপা গলায় আবার বললে, আমার সঙ্গে আসুন।
ফুটপাতের উপর দিয়ে বাড়িটার গা ঘেঁষে ঘেঁষে কিছুদূর এগিয়ে যেতেই হঠাৎ সংকীর্ণ সরু অন্ধকার গলিপথের মধ্যে বাবলু প্রবেশ করল। সুব্রত পিছু পিছু এগিয়ে চলল।
আলো-বাতাসহীন দুর্গন্ধময় দুটো বাড়ির মধ্যবর্তী সংকীর্ণ পথ।
সুব্রত জিজ্ঞাসা করল, আলো জ্বালব বাবলু?
না। আমার পিছনে পিছনে আসুন। এ পথ একমাত্র দলের লোক ছাড়া কেউ জানে না। নিকষ কালো অন্ধকারে যেন চোখের দৃষ্টি অন্ধ হয়ে যায়।
অতি কষ্টে অন্ধকারে ঠাহর করে করে বাবলুর পায়ের শব্দ অনুসরণ করে সুব্রত এগিয়ে চলে।
হঠাৎ একসময় চলতে চলতে বাবলু থেমে গেল, দাদা?
এই যে আমি!
একবার আলোটা জালুন তো!
সুব্রত পকেট থেকে টর্চ বের করে বোতাম টিপে আলো জ্বালাল।
সামনেই একটা জানালা। জানালার কপাট দুটো বন্ধ।
কতকালের কাঠের পুরাতন কপাট। মসীবর্ণ, জীর্ণ।
বাবলু উঁচু হয়ে জানালার বন্ধ কপাটের গায়ে হঠাৎ একটা ধাক্কা দিতেই কপাট দুটো ক্যাচ করে মৃদু একটা শব্দ করে খুলে গেল। জানালার গায়ে শিক বসান। মাঝখানের দুটো শিক নেই। বাকিগুলো আছে।
এই জানালা-পথে বাড়ির মধ্যে ঢুকতে হবে দাদা। দাঁড়ান, আগে আমি ভিতরে দেখে আসি, তারপর আপনি আসবেন।
বাবলু জানালার একটা শিক দুহাতে ধরে ঝুলে উঠে পড়ল। এবং পরমুহূর্তে জানালাপথে শিকের মধ্যবর্তী রাস্তা দিয়ে গলে অন্ধকার ঘরের মধ্যে ওপাশে অদৃশ্য হয়ে গেল।