বাবলু বাধা দিল, না না, রাণুদি, আজ থাক। চল আমরা বাড়িতে ফিরে যাই। আমার বড্ড ঘুম পাচ্ছে। আর একদিন এসে মালাই খাব। মা যদি আমাদের খোঁজেন, ব্যস্ত হবেন।
রাস্তার পাশের ঢাকনা দেওয়া গ্যাসের আলোয় খানিকটা রশ্মি এসে রাণুর মুখের ওপরে পড়েছে। সহসা রাণুর মুখের দিকে তাকিয়ে বাবলুর মনের মধ্যে যেন একটা অজানিত আশঙ্কা শিউরে উঠল। সমগ্ৰ মুখখানার মধ্যে যেন একটা হিংসা কুটিল জাকুটি। চোখের তারা দুটি কী এক উত্তেজনায় যেন জ্বলজ্বল করছে।
দুজনে চোখাচোখি হতেই একটু পরেই রাণু মুখের ওপরে একটা হাসি টেনে আনলে, হাসতে হাসতে বললে, কী ভীতু মেয়ে তুই বাবলু! আয় আয়। দুজনে আছি, ভয় কী? ওই তো রাস্তার মোড় দেখা যাচ্ছে! কতক্ষণই বা লাগবে। যাব আর আসব, চল।
সহসা বাবলু যেন বেঁকে দাঁড়াল। আবার রাণুর মুখের ওপরে একটু আগেকার হিংস্র কুটিল ভাবটা ফুটে উঠল। চট্ করে এগিয়ে এসে সে বাবলুর একখানা হাত দৃঢ় মুষ্টিতে চেপে ধরল এবং তীক্ষ্ণ রাগত স্বরে বললে, কী বললি পেত্নী, যাবিনে? তোকে যেতেই হবে। কোন কথা তোর আমি শুনব না। না যদি যাস, তবে তোকে খুন করে ফেলব।
সে রাত্রে পাহারা দেবার কথা ছিল শিশিরের। বাবলু আর রাণু যখন বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তায় এসে নামে, শিশিরের সদা সতর্ক দৃষ্টি তারা এড়াতে পারেনি।
রাত্রি নটার সময় ওদের দুজনকে বাড়ি থেকে বের হতে দেখে ও বেশ একটু আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ রাত্রে কেন ওরা বাড়ির বাইরে এল। দূর থেকে আড়ালে আড়ালে থেকে শিশির ওদের দুজনকে অনুসরণ করতে লাগল। ওদের দুজনেরই অজ্ঞাতে এবং ওদের অনুসরণ করতে করতে ওদের দুএকটা কথা ওর কানে আসতেই ও আরও বেশী সতর্ক হয়ে গেল।
ও স্পষ্টই বুঝল, বাবলুর অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাণু তাকে সকলের অজ্ঞাতে বাড়ির বাইরে নিয়ে এসেছে!
কিন্তু কেন? এতটুকু মেয়ে রাণু!
বাবলু কিন্তু সহসা রাণুর পরিবর্তনে চমকে গেল। রাণু যেন রাগে তখন ফুলছে। ও বলতে লাগল, পেত্নী, রাক্ষুসী! কেন তুই আমাদের বাসায় এলি? কেন মা তোকে ভালবাসবে? কেন তোকে আদর করবে? কেন তুই মরিস না? কেউ তোকে চায় না!
রাণুদি। রাণুদি! ওকথা বলল না—বোলো না। আমি তো তোমার কিছু করিনি ভাই! আমি তোমাকে কত ভালবাসি। বাবলু কেঁদে ফেলল।
ভালবাসি। কে তোকে ভালবাসতে বলেছে? কে চায় তোর ভালবাসা! তুই আর আমাদের বাড়িতে ফিরে যেতে পারবি না। আর তোকে আমাদের বাড়িতে যেতে দেব না। তুই যদি আবার আমাদের বাড়িতে যাস, তবে তুই ঘুমালে রাত্রে চুপি চুপি উঠে বাবার অপারেশনের ছুরি দিয়ে তোর গলা কেটে ফেলব।
রাণুদি! রাণুদি! ওগো তোমার দুটি-পায়ে পড়ি, আমাকে মেরো না। আমি কোথায় যাব?
তা আমি জানি না। তোর যেখানে খুশী তুই মরগে যা।
ঠিক এমনি সময় একটা কালো রঙের দ্রুতগামী সিডনবডি মোটরগাড়ি সহসা এসে ওদের সামনে ব্রেক কষে দাঁড়াল। গাড়িটা আসার সঙ্গে সঙ্গেই দুজন লোক গাড়ির দরজা খুলে নেমে ওদের সামনে এসে দাঁড়াল।
শিশির ততক্ষণে চট করে বুঝে ফেলল, একটা প্রকাণ্ড ষড়যন্ত্র আছে এর মধ্যে। আর অপেক্ষা করা নয়, সে চট করে ওদের সামনে এসে দাঁড়াল।
সহসা অন্ধকার থেকে শিশিরকে ওদের সামনে আবির্ভূত হতে দেখে তোক দুটো চমকে ফিরে দাঁড়াল। একজন কর্কশ গলায় বললে, কে তুই? কী চাস্?
শিশিরও সমানে জবাব দিলে, তোরা কী চাস্?
সহসা এমন সময় দলের একজন এগিয়ে এসে শিশিরের নাকের ওপরে অতর্কিতে ঘুষি বসালে।
অতর্কিতে আঘাত পেয়ে শিশির ঘুরে পড়ল।
দলের অন্যজন ব্যগ্রকণ্ঠে বললে, মানকে, আর দেরি নয়, শিগগির ছুঁড়িকে গাড়িতে তোল।
শিশির কিন্তু ততক্ষণে সামলে নিয়ে আবার এগিয়ে এসেছে।
তিনজনে মারামারি শুরু হয়ে গেল।
ঐ ফাঁকে বাবলু বললে, শিগগির পালিয়ে চল রাণুদি।
রাণু তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জবাব দিল, কোথায় যাবি তুই রাক্ষুসী! আমি যাব না।
বাবলু পালাতে চায়। রাণু তাকে জাপটে ধরল, না, তোকে যেতে দেব না।
এমন সময় আর একটা লোক গাড়ি থেকে নেমে এল।
বাবলু রাণুর ধত হাতখানা এক মোচড় দিয়ে ছাড়িয়ে অন্ধকারে অন্যদিকে লাফিয়ে পড়ল। ঠিক সেই সময় রাণুকে কে যেন একটা ভারী চাদর দিয়ে ঢেকে ফেললে। রাণু হাত-পা ছুঁড়ে চীৎকার করতে লাগল। কিন্তু বৃথা, লোকটা রাণুকে চাদরসমেত পোঁটলার মত তুলে নিয়ে গাড়ির মধ্যে গিয়ে ফেলে দিয়ে দরজা আটকে দিল এবং চীৎকার করে বললে, মানকে, গোবরা শিগগির আয়!
লোকটার চীৎকার শুনে মানকে-গোবরা, তাড়াতাড়ি শিশিরকে এক প্রবল ধাক্কায় ফেলে দিয়ে ছুটে গাড়ির মধ্যে গিয়ে উঠে বসল। রাস্তার একটা ইটে প্রচণ্ড আঘাত লাগায় শিশিরের মাথা তখন কেটে গিয়ে রক্ত ঝরছে। সে উঠে যাবার আগেই গাড়িটা অদৃশ্য হয়ে গেল।
ঘটনার আকস্মিকতায় বাবলু হতচকিত হয়ে গিয়েছিল। তারপর যখন দেখলে গাড়িটা চলে গেল, ও পায়ে পায়ে শিশিরের কাছে এসে দাঁড়াল। শিশির এক হাতে মাথাটা চেপে ধরে যন্ত্রণাকাতর কণ্ঠে বললে, কে?
আমি বাবলু।
বাবলু! শিশির চকিতে উঠে দাঁড়াল, তবে তোমাকে ওরা নিতে পারেনি?
একটু একটু করে তখন বাবলুর মনে সাহস ফিরে আসছে। সে শিশিরের কাছে আরও একটু এগিয়ে এল, কিন্তু ওরা যে রাণুদিকে নিয়ে গেল! কী হবে? আপনি কে?
আমার নাম শিশির। চল এখনি তোমাদের বাড়িতে যাই। সুব্রতবাবুকে ফোন করতে হবে।
বাবলুর সঙ্গে শিশির যখন ডাঃ বোসের বাড়িতে এসে প্রবেশ করল, ঠিক তখনই ডাঃ বোসও ফিরে এসে গাড়ি থেকে নামছেন। বাবলু ও শিশির গিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই ডাঃ বোসও তাদের পিছু পিছু এসে বাইরের ঘরে প্রবেশ করলেন, কে আপনি? কাকে চান? এ কি বাবলু! এত রাত্রে