সাহেব, আমি কিছু জানি না–গরিব লোক।
এখন বল, ঐ লোকগুলোকে আগে থাকতে তুই চিনতিস কিনা?
আজ্ঞে না সাহেব।
তুই উলটোপথে গাড়ি চালিয়েছিলি কেন?
সাহেব, আমার কোন কসুর নেই। আমি ঐ পথে গাড়ি নিয়ে আসছিলাম, এমন সময় সেই বাড়ি থেকে চারজন লোক বের হয়ে এসে আমাকে দশটা টাকা দিয়ে বললে, এখুনি একজন লোক একটা বন্দীকে নিয়ে ওই পথে আসবে। ওদের নিয়ে উলটোপথে আবার এখানে আসবি। আমি ভেবেছিলাম আপনি ওদেরই লোক। সেই ভেবে আমি গাড়ি উলটোপথে নিয়ে গেছি। আমার কোন কসুর নেই সাহেব।
লোকগুলো দেখে তোর মনে কোন সন্দেহ হয়নি?
না।
ওদের কাউকেই তুই কোনদিন দেখিসনি? চিনতিস্ও না?
না, সাহেব। যে লোকটা আমার সঙ্গে গাড়িতে ছিল তাকেও না?
না, সাহেব।
বেশ, আজ সন্ধ্যাবেলা আবার তোকে আমাকে সেখানে নিয়ে যেতে হবে, পারবি?
কেন পারব না সাহেব—খুব পারব!
তোর গাড়ির নং, লাইসেন্স নং, ঠিকানা সব আমাকে দিয়ে হ্যাঁ। আর আজ সারাদিন তুই হাজতে থাকবি। ওখানে আমাকে পৌঁছে দিলে তোর ছুটি।
সুব্রত কলিংবেল টিপল। একজন সার্জেন্ট এসে স্যালুট দিয়ে দাঁড়াল।
এই লোকটাকে হাজতে বন্দী করে রাখ। আর এই গাড়ির লাইসেন্সের নাম্বার আমাকে দিয়ে যাও।
সার্জেন্ট লোকটাকে নিয়ে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।
***
সুব্রত যখন আমহার্স্ট স্ট্রীটের বাসায় ফিরে এল, বেলা তখন প্রায় সাতটা।
ভৃত্যকে ডেকে এক কাপ চায়ের আদেশ দিয়ে সুব্রত সোজা গিয়ে তার শয়ন-ঘরে প্রবেশ করল।
বড় ক্লান্ত সে। পরিশ্রমের ক্লান্তিতে সর্বশরীর তখন তার নেতিয়ে পড়েছে।
প্রথমেই সে কাপড়-জামা ছেড়ে স্নানঘরে গিয়ে বেশ ভাল করে মান-পর্ব শেষ করল। তারপর এক কাপ চা খেয়ে সোজা গিয়ে সে শয্যায় আশ্রয় নিল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সে ঘুমিয়ে পড়ল।
১৩. সন্ধ্যা অনেকক্ষণ উতরে গেছে
সন্ধ্যা অনেকক্ষণ উতরে গেছে। রাত্রি তখন প্রায় সাড়ে আটটা হবে।
সুব্রত তালুকদারকে কতকগুলো আবশ্যকীয় উপদেশ দিয়ে লালবাজার থানা থেকে বের হল।
আগের রাত্রের ট্যাক্সিতে উঠে ও ড্রাইভারকে গাড়ি চালাতে বললে। ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দিল।
সুব্রত আগে থেকেই তার প্ল্যান ঠিক করে রেখেছিল। চিৎপুর রোড ও বিডন স্ট্রীট যেখানে এসে মিশেছে, সেখানে এসে সুব্রত ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বললে। গাড়ি থেকে নেমে সুব্রত ড্রাইভারকে বললে, তুমি এখন যেতে পার।
ড্রাইভার সুব্রত দিকে তাকিয়ে বিস্মিতভাবে বললে, সেখানে যাবেন না সাহেব?
না, তুমি যাও।
ড্রাইভার সুব্রতর মুখের দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্ত কি যেন ভাবলে। পরক্ষণেই সুব্রতকে একটা সেলাম দিয়ে গাড়িতে এসে উঠে বসে গাড়ি ছেড়ে দিল উলটোপথে।
গাড়িটা হাত দশ-পনেরো যেতে না যেতেই অন্য একটা ট্যাক্সি এসে সুব্রতর সামনে দাঁড়াল। সুব্রত চকিতে গাড়ির মধ্যে উঠে বসে ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে বললে, পীতাম্বর, quick—ওই আগের ট্যাক্সিটাকে অনুসরণ কর।
পীতাম্বর সুব্রতর নির্দেশমত গাড়ি নিয়ে ওখানে এসে সুব্রতর জন্য অপেক্ষা করছিল। সে সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি ছেড়ে দিল।
আগের গাড়িটা সোজা চিৎপুর রোড ধরে গিয়ে মেছুয়াবাজারের মধ্যে দিয়ে নয়া রাস্তার দিকে তখন ছুটছে।
সুব্রতর গাড়ি আগের গাড়িটার পিছু পিছু চলতে লাগল।
সুব্রত দেখতে লাগল, আগের গাড়িটা নয়া রাস্তা ধরে সোজা গিয়ে আবার বিডন স্ট্রীটে। ঢুকল। তারপর বিডন স্ট্রীট দিয়ে চিৎপুর রোডে এসে পড়ল।
চিৎপুর রোডে পড়ে বরাবর সেই বাড়িটার দিকেই এগুতে লাগল। বাগবাজারের কাছাকাছি এসে সহসা গাড়িটা আনন্দ চ্যাটার্জি লেনের মুখে এসে দাঁড়িয়ে গেল।
পীতাম্বরও গাড়ি থামালে।
সুব্রত পীতাম্বরকে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করতে বলে গলির দিকে এগিয়ে গেল। কেননা আগের ট্যাক্সির ড্রাইভার তখন গাড়ি থেকে নেমে গলির মধ্যেই অদৃশ্য হয়েছে।
সুব্রত গলির মধ্যে প্রবেশ করে দেখলে, গলিটা বেশ প্রশস্ত। গলির মাথায় একটা মস্ত বড় পুরাতন বাড়ি। তারই একটি নীচের ঘরে আলো জ্বলছে এবং অনেক লোকের গোলমাল শোনা যাচ্ছে। খোলা দরজার ওপরে একটা সাইন বোর্ড ঝুলছে, চাচার হোটেল।
সুব্রত ইতিমধ্যেই গাড়ির মধ্যে বসে বসে তার বেশভূষার কিঞ্চিৎ পরিবর্তন করে নিয়েছিল। এখন কেউ তাকে দেখলে একজন সাধারণ কুলি শ্রেণীর লোক ছাড়া অন্য কিছু ভাববে না।
সুব্রত গিয়ে চাচার হোটেলে প্রবেশ করল।
ঘরের মধ্যে উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলছে। মাংস ও পরটার গন্ধ নাকে ভেসে আসে। বেশ প্রশস্ত ঘরখানি। মাঝে মাঝে চেয়ার পাতা। দশ-বারো জন কুলী শ্রেণীর লোক বসে চা ও নানা জাতীয় খাবার খাচ্ছে।
সুব্রত আশেপাশে একটু নজর দিতেই দেখতে পেলে, সেই শিখ ড্রাইভারটা কাউন্টারে উপবিষ্ট একজন মাঝারি বয়সের নাদুসনুদুস লোকের সঙ্গে ফিসফাঁস করে কি সব বলছে।
কাউন্টারের যে খালি চেয়ারটা ছিল, সেটার ওপরে উপবেশন করে সুব্রত এক কাপ চায়ের অর্ডার দিল এবং সঙ্গে সঙ্গে কান খাড়া করে শোনবার চেষ্টা করতে লাগল ওরা কী বলাবলি করছে।
সুব্রত শুনতে পেলে কাউন্টারের লোকটা বলছে, তোর পিছু কেউ নেয়নি তো রে?
না! টিকটিকি ব্যাটা মাঝরাস্তায় নেমে গেল! উঃ, খুব বেঁচে গেছি। শালা আমার সব ভুল নম্বরগুলো নিয়ে নিয়েছে। কিন্তু কর্তা আজ এখানে আসছে নাকি?
তা বলতে পারি না, তবে তোর প্রাপ্য কুলীর কাছে আছে–চাইলেই পাবি।
একটা ছোকরা এসে এক কাপ চা সুব্রতর সামনে টেবিলের ওপর রেখে গেল।