সুব্রত চকিতে তার আশেপাশে একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলিয়ে দেখে নিল। সামনের গলিপথটা প্রশস্ত হয়ে গেছে। সামনেই দেখা যায় দুদিককার দেওয়ালে দুটো দরজা। একটার কবাট বন্ধ, অন্যটার খোলা। খোলা কবাটের সামনেই লোক দুটো দাঁড়িয়ে।
তিনজনেই নিস্তব্ধ, নিঝুম। কারও মুখে কোন কথা নেই। যেন একটা বরফের মত ঠাণ্ডা নিস্তব্ধতা—অন্ধকারে কণ্ঠনালী চেপে ধরেছে। সহসা আবার সুব্রত তার টর্চের আলো একজনের মুখের ওপরে প্রতিফলিত করলে। লোকটা হঠাৎ চোখটা বুজে ফেললে মুহূর্তের জন্য। আর সেই মুহূর্তের অবকাশে সুব্রত চোখের পলকে মরিয়া হয়ে বিড়ালের মত নীচু হয়ে বসে পড়ে লোকটার পায়ে এক লাথি মারলে।
লোকটার হাতে টর্চ ছিল। সে হঠাৎ ঐভাবে আক্রান্ত হয়ে একপাশে ছিটকে পড়ল এবং সঙ্গে সঙ্গে একটা আর্ত চীৎকার করে উঠল। লোকটার হাত থেকে টর্চ ও পিস্তলটা ছিটকে পড়ল মাটিতে।
অন্য লোকটা ততক্ষণে সুব্রতর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সুব্রত তাকে জাপানী যুযুৎসুর প্যাচে মুহূর্তে ধরাশায়ী করল।
অন্য লোকটার পায়ে বেশ চোট লেগেছিল। কিন্তু তবু সে উঠে বসেছে। সুব্রত তাকে আক্রমণ করবার সুযোগমাত্র না দিয়ে আবার যুযুৎসুর পাঁচে ধরাশয়ী করলে এবং পরক্ষণেই সে আলো জ্বেলে প্রথমেই পিস্তল দুটো করায়ত্ত করে নিল।
একটা পিস্তলের লোহার বাঁট দিয়ে উঠে বসা লোটারই মাথায় প্রচণ্ড এক আঘাত করতেই লোকটা অস্ফুট কাতর শব্দ করে তখুনি আবার জ্ঞান হারিয়ে ঘুরে পড়ে গেল। দ্বিতীয় লোকটা
তখন উঠে বসে সুব্রতর দিকে পিটপিট করে চাইছে।
সুব্রত লোকটার দিকে এগিয়ে এসে তার মাথায় পিস্তলের নলটা দিয়ে একটা মৃদু খোঁচা দিয়ে ব্যঙ্গ করে বললে, কি হে বন্ধু, কেমন মনে হচ্ছে এখন! লক্ষ্মী ছেলের মত উঠে দাঁড়াও তো দেখি।
লোকটা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল।
শোন সোনার চাঁদ, যা বলব আমি তাই কর তো দেখি। নইলে আমার হাতে পিস্তল—
লোকটা দেখতে যেমন মোটা, তেমনি লম্বা-চওড়া।
মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মাথায় ঝড়া আঁড়া চুল—বিস্ত, এলোমেলো।
ডান দিককার কপালে একটা গভীর ক্ষতচিহ্ন। চোখ দুটো গোল কুতকুতে। দৃষ্টি নিষ্ঠুর ধারাল ছুরির ফলার মতই। রক্তলালসায় হিংস্র যেন।
পরিধানে সাধারণ কুলিদের মত ময়লা ধুতি ও একটা কোর্তা।
লোকটা তার কুতকুতে দৃষ্টিতে সুব্রতর মুখের দিকে চেয়ে ভারী খনখনে গলায় বললে, কি চাও তুমি?
এই সুড়ঙ্গ থেকে প্রথমে বের হতে চাই। লক্ষ্মী ছেলের মত এখন আমায় বের হবার পথ দেখিয়ে দাও দেখি সোনার চাঁদ!
বেশ, চল। লোকটি অগ্রসর হল।
লোকটার পিছু পিছু সুব্রতও অগ্রসর হল।
১২. প্রায় পাঁচ মিনিট চলার পর
প্রায় পাঁচ মিনিট চলার পর দেখা গেল আবার একটা সিঁড়ি।
সুব্রত অগ্রগামী লোকটাকে অনুসরণ করে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল।
সিঁড়িটা গিয়ে শেষ হয়েছে একটা টানা বারান্দায়। বারান্দা দিয়ে খানিকটা এগুবার পর। সামনে দেখা গেল দুটো দরজা। একটা ভোলা, অন্যটা বন্ধ। লোকটা খোলা দরজাটার দিকে না গিয়ে বন্ধ দরজাটা দিকে এগিয়ে চলল।
সুব্রত হঠাৎ থামল। বললে, ঐ খোলা দরজাটা দিয়ে চল।
লোকটা ফিরে দাঁড়িয়ে আগের মতই খনখনে গলায় বললে, না।
সুব্রত ভ্রূ দুটো কুঁচকে সন্দিগ্ধ স্বরে বললে, কেন, না?
লোকটা বললে, এইটাই বাইরে যাবার রাস্তা। বলে সে বন্ধ দরজাটার দিকে আঙুল তুলে দেখাল।
খোলা দরজাটা দিয়ে তাহলে কোথায় যাওয়া যায়?
লোকটা ভারী গলায় জবাব দিলে, অত খোঁজে তোমার দরকার কী? এ বাড়ির বাইরে যেতে চাও—চল বাইরে নিয়ে যাচ্ছি।
উঁহু, আগে আমাকে বলতে হবে ঐ দরজাটা দিয়ে কোথায় যাওয়া যায়! সুব্রত কঠোর স্বরে প্রশ্ন করলে।
বলতে পারব না। লোকটা সমান গলায় জবাব দিলে।
সুব্রত পিস্তলটা উচিয়ে লোকটার দিকে আরও একটু এগিয়ে এল। তারপর তীক্ষ্ণ আদেশের। স্বরে বললে, দেখ সোনার চাঁদ, গোলমাল করে লাভ হবে না। পাশার দান উলটে গেছে। আমার হাতের মুঠোর মধ্যে তোমার মরণ-বাঁচন। আমার কথা না শুনলে মুহূর্তে তোমাকে কুকুরের মত গুলি করে মারতে পারি, তা জান? এসো, ভাল চাও তো লক্ষ্মী ছেলের মত দরজাটা খুলে এগোও।
না।
কিন্তু আমি বলছি, হ্যাঁ। তোমাকে খুলতেই হবে।
খুলব না। তোমার হাতের পিস্তলকে আমি ডরাই না। তাছাড়া মরার থেকে আমরা বেশী ডরাই নেকড়ের থাবা-কে।
সুব্রত ক্ষণকাল যেন কি ভাবলে। হঠাৎ মনে হল, তার মাথার ওপরে কার যেন পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।
এমনি করে প্রতি মুহূর্তে অনিশ্চিত ভাবে আসন্ন বিপদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সময়ক্ষেপ করা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে সুব্রত বললে, বেশ চল, যে রাস্তা দিয়ে যেতে চাও।
লোকটা তখন অগ্রসর হয়ে পকেট থেকে একটা চাবির গোছা বার করে একটা চাবি দিয়ে দরজাটা খট্ করে খুলে ফেললে।
দরজাটা খুলতেই একটা ঠাণ্ডা শীতল হাওয়ার ঝলক এসে সুব্রতর চোখেমুখে যেন শান্তি ও আরামের ঝাপটা দিল।
আঃ! সুব্রত একটা আরামের নিঃশ্বাস নিল।
লোকটা দরজা খুলে একপাশে সরে দাঁড়িয়ে বললে, চলে যাও—সামনেই রাস্তা।
সুব্রত একটু মৃদু হেসে বললে, ধন্যবাদ। কিন্তু বন্ধু, একা একা যেতে আমি রাজী নই। তোমাকেও আমার সঙ্গে কিছুটা পথ যেতে হবে।
আমি আর এক পাও যেতে পারব না। লোকটা দৃঢ়কণ্ঠে জবাব দিল।
কিন্তু আমার হুকুম, তোমাকে আমার সঙ্গে যেতেই হবে।
যদি না যাই?
তবে যাতে যেতে বাধ্য হও সেই চেষ্টাই করা হবে।