প্রথমেই আলো দিয়ে ও খুঁজতে লাগল ঘরে কোন দরজা আছে কিনা।
একদিককার দেওয়ালে একটা বন্ধ দরজা ওর নজরে পড়ল। কিন্তু দরজাতে ধাক্কা দিতে দেখলে দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। তাছাড়া, দরজাটা শক্ত সেগুন কাঠের। সাধ্য কী ওর দরজাটা ভেঙে ফেলে পায়ের জোরে!
লোহার মতই শক্ত। তবু একবার ও দেহের সমগ্র শক্তি একত্রিত করে দরজাটার ওপরে চাপ– দিল। কিন্তু বৃথা চেষ্টা।
তখন কতকটা হতাশ হয়েই সে ঘরের দেওয়ালগুলা পরীক্ষা করে দেখতে লাগল।
নিরেট ইট ও সিমেন্টের তৈরি দেওয়াল। কোথাও একটুকু ফাঁক নেই।
দেওয়ালে দেওয়ালে ও টোকা মেরে দেখলে, যদি কোথাও ফাপা থাকে। কিন্তু না, শক্ত। নিরেট দেওয়াল।
পরিশ্রমে ও ক্লান্তিতে ওর কপালের ওপরে তখন বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিয়েছে।
ধুপ করে সুব্রত তখন ধূলিমলিন মেঝের ওপরে বসে পড়ে দুহাতে মাথাটা টিপে ধরল।
না, কোন আশাই নাই। কিন্তু কী করবে ও এখন?
১১. কিন্তু এমনি করে বসে থাকলে
কিন্তু এমনি করে বসে থাকলে তো চলবে না।
মুক্তির একটা কিছু উপায় বের করতেই হবে। আবার তখন দ্বিগুণ উৎসাহে সুব্রত উঠে দাঁড়াল। এবারে সে হাতের টর্চটা জ্বেলে আলো ফেলে ফেলে ঘরের মেঝেটা ভাল করে পরীক্ষা করে দেখতে শুরু করল।
শক্ত সিমেন্টে গড়া মেঝে। লোহার মত কঠিন।
প্রায় এক ইঞ্চি পরিমাণ ধুলো পুরু হয়ে জমে আছে।
ধুলো সরিয়ে সরিয়ে সুব্রত মেঝে ঠুকে ঠুকে পরীক্ষা করে দেখতে লাগল। হঠাৎ এক জায়গায় ওর নজরে পড়ল, একটা লোহার উঁচু বন্টুর মত কী যেন মেঝে থেকে উঁচু হয়ে আছে।
সুব্রত তখন সেটাতে নিয়ে প্রবল উৎসাহে নাড়াচাড়া করতে শুরু করল। কিন্তু সেটা মেঝের সিমেন্টের সঙ্গে একেবারে গাঁথা।
সুব্রত ভাবলে এটা যখন মেঝেতে আছে, এর একটা উদ্দেশ্যও নিশ্চয়ই আছে।
হঠাৎ মেঝেতে একটা লোহার বন্টুর মতই থাকতে যাবে কেন?
সুব্রত আবার আলো ফেলে ফেলে ঘরের মেঝের সর্বত্র খুঁজে দেখলে। কিন্তু আর কোথাও ও রকম লোহার বন্টু তার নজরে পড়ল না।
সুব্রত যখন অনেক চেষ্টা করে ও গায়ের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করেও সেটাকে এতটুকু নড়াতে পারল না, তখন সে তার ছুরিটা দিয়ে বন্টুর চারপাশে কুরে কুরে ফেলতে লাগল।
ফলে কিছুক্ষণের মধ্যেই বল্টুটা আরও একটু সজাগ হয়ে উঠল। এবার হঠাৎ কী ভেবে সুব্রত বন্টুটার ওপরে দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড একটা চাপ দিল। সঙ্গে সঙ্গে একটা ঘড়ঘড় শব্দ। চোখের। নিমেষে বন্টুটার ঠিক হাতখানেক দূরে মেঝের পাথর সরে গিয়ে একটা গোলাকার গর্ত দেখা গেল। সুব্রত এক লাফ দিয়ে সেখান থেকে সরে দাঁড়াল।
বুকটার মধ্যে তখনও তার উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে।
সুব্রত এগিয়ে এসে গর্তটার মুখে আলো ফেলল। দেখল মেঝেতে যেখানে পাথর সরে গিয়ে ফাঁক হয়ে গেছে, সেখানে একটা গোলাকার সিমেন্টের ঢাকনা মত নিচের দিকে ঝুলছে। গর্তের মুখে ও আবার আলো ফেলল। ধাপে ধাপে অপ্রশস্ত সিঁড়ি নীচে কোন্ অন্ধকার গহ্বরে নেমে গেছে কে জানে! ও এতক্ষণে বুঝতে পারলে এটা একটা গোপন সুড়ঙ্গ পথ। কোন স্প্রিং বা ওই জাতীয় কিছুর সাহায্যে কাজ করে।
সুব্রত মনে মনে ভাবলে, আশ্চর্য! জানি না এই সিঁড়ি কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে। এই সিঁড়ি ধরে এগোলে শেষ পর্যন্ত কোথায় যেতে হবে কে জানে? হয়তো বা সাক্ষাৎ মৃত্যুর গহ্বর বরাবর। চলে গেছে। এখন এই পথ ধরে অগ্রসর হওয়া উচিত কিনা? কিন্তু অগ্রসর না হয়েই বা লাভ কী? এইখানে এই ঘরের মধ্যে বসে থাকলেও তো মুক্তির কোনই উপায় হবে না। এখানে তাকে এইভাবে বন্দী করে রেখেছে শত্রুপক্ষ, তারা নিশ্চয়ই আরামে বসে থাকবে না। তারা যদি দলে ভারী হয় এবং তাদের হাতে অস্ত্রশস্ত্র থাকে, তবে মুক্তির পথ আরও দুরূহ হওয়াই স্বাভাবিক। এ অবস্থায় বিবেচনা করে দেখতে গেলে অগ্রসর হওয়াই উচিত। হয়তো বা এই পথের শেষে মুক্তি মিললেও মিলতে পারে। চান্স একটা নেওয়া দরকার।
সুব্রত উঠে দাঁড়াল। হ্যাঁ, সে এই পথ ধরেই অগ্রসর হবে।
সুব্রত গর্তের ভিতরে নামল এবং সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতে শুরু করল। উঃ, কী অন্ধকার। গাঢ় কালির মতই শ্বাসরোধকারী জমাট-বাঁধা অন্ধকার।
সুব্রত সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে একবার থমকে দাঁড়াল। কোন শব্দ শোনা যায় কিনা?
না, কিছুই শোনা যায় না।
সুব্রত আবার সিঁড়ি ভাঙতে লাগল। এক, দুই। এমনি করে প্রায় বারোটা সিঁড়ির ওপরে ওর পা সমতলভূমিতে ঠেকল।
ও দাঁড়াল। হাতের টর্চটা জ্বেলে ও চট করে একবার তার আশপাশ আলোতে দেখে নিল। সরু অপ্রশস্ত গলিপথ। কিন্তু কোথায় গিয়ে যে ঐ পথ শেষ হয়েছে কিছুই তার বোঝবার উপায়। নেই। যেন বিরাট একটা কালো অজগর মুখব্যাদান করে আছে।
সুব্রত আবার অগ্রসর হল।
বোধ হয় দশ পাও সে অগ্রসর হয়নি, সহসা কার তীব্র কণ্ঠস্বর নির্ঘোষে ওর কানে এসে। বাজল, থাম!
তারপরেই একটা তীব্র আলোর রশ্মি ওর চোখেমুখে এসে সুতীব্র ঝাপটা দিল।
কিহে মাস্টার, চলেছ কোথায়?
বিস্ময়ে ও ঘটনার আকস্মিকতার সুব্রত থমকে দাঁড়িয়ে গেল।
ও দেখলে গলিপথ কখন প্রশস্ত হয়ে গেছে, সামনে যমদূতের মত দুজন লোক তাদের দুজনেরই হাতে উদ্যত পিস্তল।
সুব্রত তার হাতের টর্চটা জ্বাললে এবং নিঃশব্দে লোক দুটোর মুখের ওপরে প্রতিফলিত করল। শান্ত অবহেলার ভঙ্গিতে লোক দুটি দাঁড়িয়ে আছে। মুখে তাদের কঠোর সংকল্পের নিষ্ঠুর অভিব্যক্তি।
সুব্রত নিরস্ত্র। সম্বল মাত্র জাপানী ছুরিটা! দুটো পিস্তলের কাছে ওটা কিছুই নয়।