সুব্রত গিয়ে সামনের ঝুলন্ত দামী পর্দাটা সরিয়ে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।
০২. প্রশস্ত একটি হলঘর
প্রশস্ত একটি হলঘর। মেঝেতে পুরু দামী কার্পেট বিছানো। দামী দামী কোচ ও সোফায় ঘরখানি অতি আধুনিক কেতায় সুসজ্জিত। দেওয়ালে দেওয়ালে দামী দামী বড় বড় অয়েলপেন্টিং ঝুলছে।
ঘরের চার কোণে স্ট্যান্ডের ওপরে জয়পুরী পিতলের টবে পামট্রি। ঘরটা খালি।
সুব্রত ইতস্তত তাকাতে লাগল, কি করবে এখন সে? কোন্ পথে যাবে এবার?
এমন সময় হঠাৎ সামনের একটা পর্দা তুলে ছাব্বিশ-সাতাশ বৎসরের একটি অতি সুদর্শন যুবক ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল।
বড় বড় দুটি হরিণের মত গভীর কালো ছলছল চোখ। চোখের দৃষ্টিতে ফুটে উঠেছে যেন গভীর এক আকুলতা।
একমাথা কোকড়া কোঁকড়া চুল, বিস্রস্ত এলোমেলো। টিকোল নাসা।
পরনে দামী শান্তিপুরী ধুতি। গায়ে গরম পাঞ্জাবি।
ভদ্রলোক হঠাৎ ঘরের মধ্যে সুব্রতকে দেখে থেমে গিয়ে আবার সুব্রতর দিকে এগিয়ে এলেন।
সুব্রত স্পষ্টই লক্ষ্য করল এবার। ভদ্রলোক বাঁ পা-টা যেন একটু টেনে টেনে চলছেন। সুব্রতর আজ সকালে পাওয়া চিঠিটার কথা মনে পড়ে গেল।
সুব্রতই প্রথমে প্রশ্ন করল, আপনি বোধ হয় এ বাড়িরই কেউ হবেন নিশ্চয়ই?
হ্যাঁ।
আপনার নামটা জিজ্ঞাসা করতে পারি কি?
বিনয়েন্দ্র সরকার।
গজেনবাবুর বৈমাত্রেয় ভাই, তাই না?
হ্যাঁ। কথাটা বলে ভদ্রলোক যেন রীতিমত বিস্ময়ের সঙ্গেই কয়েকটা মুহূর্ত সুব্রতর দিকে তার ডাগর চোখের নীরব দৃষ্টি নিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে কোনমতে একটা ঢোক গিলে বললেন, কিন্তু আপনি? আপনাকে তো
সুব্রত স্মিতভাবে বললে, চিনবেন না। আমার নাম সুব্রত রায়। সি. আই. ডি. ইন্সপেক্টর মিঃ তালুকদার এখানে আছেন?
আপনি পুলিসের লোক?
হ্যাঁ।
উপরে তারা সব আছেন, চলুন।
মৃতদেহ কোথায়?
উপরে লাইব্রেরি ঘরে।
আমাকে ঘরটা একটু দেখিয়ে দিতে পারেন?
হ্যাঁ, চলুন।
বিনয়েবাবুর পিছনে পিছনে সুব্রত অগ্রসর হল। হলঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে ওরা একটা লম্বা টানা বারান্দায় এসে পড়ল।
বারান্দার শেষ সীমান্তে দোতলায় ও তিনতলায় ওঠবার সিঁড়ি। সিঁড়িটা আগাগোড়া মারবেল : পাথরের তৈরি, প্রশস্ত। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে দোতলায় এল ওরা।
দোতলায়ও একতলার অনুরূপ একটা টানা বারান্দা। বারান্দায় রেলিংয়ের গা ঘেঁষে পিতলের টবে নানা প্রকারের পাতাবাহার। পামট্রি ও সিজন ফ্লাওয়ারের বিচিত্র সমাবেশ।
বারান্দার শেষপ্রান্তে একটা ঘরের পর্দা তুলে বিনয়ে বললেন, এই ঘরে।
সুব্রত ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল।
ঘরের মধ্যে ঐসময় কেউ ছিল না। আকারে ঘরখানি বেশ প্রশস্ত। মেঝেতে দামী পুরু কার্পেট বিছানো। ঘরের মধ্যে চারপাশের দেওয়ালের কোল ঘেঁষে সার সার কাঁচের আলমারি। প্রত্যেকটি আলমারির মধ্যে থাকে থাকে সব বই সাজানো। ঘরের মধ্যে দুতিনখানি দামী গদীআঁটা সোফা ও কাউচ। খান দুই ছোট টেবিল।
ঘরের এককোণে একটি ভেনাসের প্রতিমূর্তি। প্রতিমূর্তির ঠিক নীচেই একটি সুবৃহৎ দামী ঘড়ি। দুটো বেজে বন্ধ হয়ে আছে। ঘরের চার দেওয়ালে চারটি অয়েলপেন্টিং।
হঠাৎ সুব্রতর নজরে পড়ল, ঘরের দক্ষিণ কোণে যেখানে বোধ হয় পাশের ঘরের দরজার পর্দা ঝুলছে তারই সামনে ছোট একটি টেবিল। টেবিলের ওপরে একখানা মোটা বই খোলা।
টেবিলের সামনেই একটা আরাম কেদরায় হেলান দিয়ে বসে আছেন এক বৃদ্ধ।
বিনয়ে বললেন, ঐ যে!
সুব্রত এগিয়ে যায়।
বৃদ্ধা মারা গেছেন কে বলবে? যেন চোখ বুজে বসে আছেন। কী ধীর সৌম্য শান্ত বৃদ্ধের চেহারা! শ্বেতশুভ্র চুলগুলি বিস্রস্ত এলোমেলো। দাড়ি-গোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো। পরিধানে দামী পায়জামা ও শালের পাঞ্জাবি। নিমীলিত দুটি আঁখি! বাঁ হাতটা আরামকেদারায় হাতলের ওপর দিয়ে নীচের দিকে ঝুলছে, ডান হাতটি কোলের ওপরে। নিস্তব্ধ ঘরের মধ্যে যেন মৃত্যু এসে নিঃশব্দে তার আসন পেতেছে।
ঐসময় সামনের পর্দা তুলে তালুকদার এসে লাইব্রেরি ঘরে প্রবেশ করলেন, এই যে সুব্রতবাবু, এসে গেছেন!
সুব্রত তালুকদারের দিকে মুখ তুলে তাকাল।
মৃতদেহ দেখলেন? ঠিক যেন ঘুমিয়ে আছেন। কোথাও এতটুকু struggle-এর চিহ্ন পর্যন্ত নেই।
সুব্রত মৃদুস্বরে প্রশ্ন করলে, ডাঃ আমেদকে খবর দিয়েছেন, তালুকদার?
হুঁ। এখানে আসবার আগেই। এখুনি হয়তো তিনি এসে পড়বেন। কিন্তু আপনি সংবাদ পেলেন কি করে?
সুব্রত সংক্ষেপে চিঠি-প্রাপ্তির কথা খুলে বললে। তারপর আবার প্রশ্ন করলে, মৃত্যুর কারণ কিছু পেয়েছেন তালুকদার?
না। মৃতদেহ আমি স্পর্শ করিনি, তবে বাইরে থেকে যতটুকু সম্ভব পরীক্ষা করে দেখেছি, কোন আঘাতের চোখে পড়েনি। মনে হচ্ছে, হয়ত কেষ্টা সুইসাইড হতে পারে।
সুব্রত কোন জবাব না দিয়ে মৃতদেহের দিকে এগিয়ে গেল!
মৃত সরকারের পাঞ্জাবির বোতামগুলি ভোলা। পাঞ্জাবির বুকের বাঁদিককার অংশ বাঁদিকে ঝুলে পড়েছে। সুব্রত তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে ঝুঁকে পড়ে মৃতদেহ পরীক্ষা করতে লাগল।
হঠাৎ দেখতে দেখতে নজরে পড়ে, মৃতদেহের বুকে ছোট একটি রক্তবিন্দু শুকিয়ে কালো হয়ে যেন জমাট বেঁধে আছে?
আরও নজরে পড়ল, মৃতের নাকের ওপরে ছোট ঘোট দুটি কিসের দাগ! সুব্রত একটু নীচু হয়ে পরীক্ষা করতে লাগল। হঠাৎ যেন একটা মিষ্টি গন্ধ পায় সুব্রত। মৃতের মুখ থেকে ও গন্ধটা পাওয়া যায়। সুব্রত আঙুলের নখ দিয়ে বুকের রক্তবিন্দু তুলে ফেলতেই দেখতে পেল, একটা সুচাগ্র পরিমাণ ছিদ্র!