ছুরিটা এসে সাঁ করে সুব্রতর ডান হাতে আঘাত হানল। সঙ্গে সঙ্গে রিভলভারটা ওর হাত থেকে ঠন্ করে মাটিতে পড়ে গেল।
সুব্রত পিস্তলটা মাটি থেকে কুড়িয়ে নেবার আগেই কে একজন ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ঘাড়ের উপর। সুব্রত এক ঝাকানি দিয়ে লোকটাকে ফেলে দিতেই লোকটা অন্ধকারে সুব্রতর পা চেপে ধরল।
সুব্রত আবার পড়ে গেল।
ততক্ষণে আরও একজন এসে সুব্রতর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে গেল সেই অন্ধকারেই।
সুব্রত একজনের পেটে একটা প্রচণ্ড লাথি বসিয়ে দিল। লোকটা গ্যাক করে শব্দ করে ছিটকে পড়ল।
সুব্রত সবে উঠে দাঁড়িয়েছে, সহসা কে তার মাথার ওপরে অন্ধকারেই একটা প্রচণ্ড আঘাত হানল।
সুব্রত চোখে অন্ধকার দেখে। সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
কতক্ষণ যে সুব্রত অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল তা ও বলতে পারে না। ক্রমে এক সময় একটু একটু করে ওর জ্ঞান ফিরে এল।
মাথাটা তখনও বেশ ভারী। ঝিমঝিম্ একটা ভাব। শরীরটা বরফের মত জমাট বেঁধে গেছে। রক্ত চলাচল একেবারে বন্ধ।
চোখের পাতা দুটো খুলতে তখনও বেশ কষ্ট হয়। কোথায় আছে সে?
কী অন্ধকার! কালো বাদুড়ের ডানার মত অন্ধকার চাপ বেঁধে উঠেছে যেন।
একটা ধুলোবালির সোঁদা গন্ধে নাক জ্বালা করে।
পাশ ফিরতে গেল, সমস্ত শরীরটা যেন একই সঙ্গে প্রতিবাদ করে উঠল। ও বুঝতে পারলে, ওর হাত-পা সব বাঁধা শক্ত দড়ি দিয়ে।
হাত দুটো রাঁধা অবস্থাতেই চোখের কাছে নিয়ে এল। হাত দুটো শক্ত করে বাঁধা, পৃথক করবার উপায় নেই।
অন্ধকার ঘরের মধ্যে ও চেয়ে দেখতে লাগল, ওই মাথার ওপরে দেওয়ালের গায়ে ঘুলঘুলি দিয়ে একটু যেন ক্ষীণ আলোর আভাস পাওয়া যায়।
ও বুঝতে পারলে, ওকে হাত-পা বেঁধে একটা ধূলিমলিন তক্তপোষের ওপরে ফেলে রেখে গেছে ওরা।
এই বদ্ধ ঘরের অন্ধকার থেকে কে তাকে মুক্তি দেবে? বেঁকের মাথায় সহসা অমনভাবে। একটা মাত্র পিস্তলের ওপরে নির্ভর করে চারজন শত্রুর সম্মুখীন হওয়া তার কোনমতেই উচিত হয়নি।
কপালের দুপাশের রগ দুটো যেন বেদনায় দপদপ করছে।
শরীরের সর্বত্র একটা ক্লান্তি, বেদনা।
উঃ, কী অন্ধকার।
চোখের দৃষ্টি বুঝি অন্ধ হয়েই যাবে।
কিছুক্ষণ একান্ত নিঃসহায় ভাবেই ও কান পেতে যেমন পড়েছিল তেমনি পড়ে রইল। যদি কোন শব্দ শোনা যায়।
কিন্তু কোন শব্দই পাওয়া যাচ্ছে না।
মৃত্যুর মতোই জমাট শীতল অন্ধকার যেন অক্টোপাশের মত অষ্ট মৃত্যুবাহু বাড়িয়ে তাকে জড়িয়ে ধরেছে।
ঘরের মধ্যে বদ্ধবায়ু—যেন শ্বাস নিতেই কষ্টবোধ হয়।
সহসা পাগলের মত সে একবার হাতের বাঁধনটা ছিঁড়ে ফেলতে চেষ্টা করলে, কিন্তু সবই বৃথা। সরু শক্ত দড়িতে এমনভাবে বাঁধা যে, সাধ্য কি তার ছিঁড়ে ফেলে সে বাঁধন? দড়িটা খুলবার চেষ্টা করতে গিয়ে ফল এই হল যে, হাতের ওপরে বাঁধনটা চামড়া ও মাংস কেটে আরও শক্ত হয়ে বসে গেল।
উপায় নেই। এমনি ভাবেই বদ্ধ অবস্থায় এই অন্ধকার বায়ুলেশহীন ধূলিমলিন ঘরের মধ্যে পড়ে থাকতে হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না বাইরে থেকে কেউ এসে তাকে মুক্তি দেয়।
কিন্তু কেইবা তাকে মুক্তি দিতে আসবে এই অন্ধকার কারাগুহা থেকে? কেইবা জানতে পারবে?
সে কোথায় আছে তা তো সেও জানে না।
এখনও কি সেই চিৎপুরের বাড়িটারই কোন ঘরের মধ্যে বন্দী হয়ে আছে সে? এখন কি রাত্রি, না দিন হয়েছে?
হয়তো এমন কোন পোড়ো বাড়ির এক কুঠুরির মধ্যে তাকে বন্দী করে রেখেছে যার। আশেপাশে মাইলখানেকের মধ্যে হয়তো মানুষের চিহ্নও নেই। মানুষ হয়তো সেখানে মোটেই আসে না।
হয়তো তিলতিল করে তাকে এই বদ্ধ বায়ুলেশহীন অন্ধকার ঘরের মধ্যে এমনি হাত-পা বাঁধা অবস্থাতেই ক্ষুৎপিপাসায় কাতর হয়ে মরে যেতে হবে। কেউ জানবে না, কেউ শুনবে না তার আর্ত-কাতর চিৎকার।
আর যদি কেউ আসে, সে হয়তো শত্রুপক্ষেরই কেউ হবে। যে তার দুর্দশা দেখে নেকড়ের মত দাঁত বের করে হ্যাঁ হ্যাঁ করে নিষ্ঠুর হাসি হাসবে।
কিন্তু না, এসব কি পাগলের মত ভাবছে ও! যেমন করেই হোক তাকে মুক্তি পেতেই হবে।
মনে পড়ল বহুদিন আগে একবার সে এমনি এক ঘরে বিখ্যাত দস্যু কালো ভ্রমরের চক্রান্তে বন্দী হয়েছিল। কিন্তু সেখান থেকে তো সে পালিয়েছিল। হঠাৎ তার মনে যেন আশার একটা জোয়ার এসে ঝাপটা দিল।
ওর সমগ্র অন্তর যেন বাঁচবার একটা অদম্য প্রেরণায় সহসা আবার নবীন বলে বলীয়ান হয়ে উঠল।
বাঁচতে তাকে হবেই। বিপদে সাহস হারালে চলবে না।
ধীরে ধীরে বহু কষ্টে ও কোনমতে ঐ বাঁধা অবস্থাতেই উঠে বসল।
হঠাৎ তার মনে পড়ল, তার ডান পায়ের জংঘার নীচে একটা তীক্ষ্ণ জাপানী ছুরি বাঁধা আছে।
কিন্তু সে ছুরিটা সে বের করবে কী করে?
নিচু হয়ে দাঁত দিয়ে ও হাঁটুর উপরে কাপড়টা ছিঁড়ে ফেললে। তারপর কোনমতে বাঁধা হাতের আঙুল দিয়ে ছুরিটা টেনে বের করল। তখন তার বাঁধন কাটতে বেশী দেরি হল না।
ছুরিটা দাঁতে চেপে ধরে প্রথমেই হাতের বাঁধন একটু একটু করে সে কেটে ফেললে। তারপর পায়ের ও শরীরের।
সে এখন মুক্ত।
আনন্দে ওর মুখের ওপরে হাসি ফুটে উঠল।
বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে ও খাটের উপর থেকে নীচে নেমে দাঁড়াল।
পকেট হাতড়ে দেখলে তার পেনসিলটর্চটা আছে কিনা?
ধন্যবাদ! ভগবানকে অশেষ ধন্যবাদ, টর্চটা তখনও তার পকেটের ক্লিপে আঁটা আছে। শত্রুরা নিয়ে নেয়নি।
বোতাম টিপতেই একটা সরু আলোর রেখা অন্ধকারের বুক চিরে জেগে উঠল—যেন তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী একটা দৃষ্টি।