এগিয়ে যেতে যেতে ওর মনে হল, মাথার ওপরে কার যেন পায়ের চলার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ও বুঝলে, লোকগুলো দোতলাতেই গেছে।
কিন্তু দোতলায় যাবার সিঁড়ি কোথায়? যতদূর মনে হচ্ছে নীচের তলায় কেউ নেই। ও পকেট থেকে টর্চটা বের করে বোম টিপে আলোটা জ্বালাতেই দেখতে পেল, যেখানে ও দাঁড়িয়ে আছে সেটা লম্বা একটা বারান্দা।
সামনেই একটা প্রশস্ত জঙ্গলাকীর্ণ আবর্জনাপূর্ণ আঙিনা। বারান্দার মেঝেতে এক ইঞ্চি পরিমাণ ধুলোবালি জমে আছে। বেশ বোঝা যায় যে, বাড়িটায় কেউ বাস করে না। আর বসবাস করলেও এমনভাবেই বাস করে যে, বসবাসের তারা কোন চিহ্নই রাখতে চায় না। নীচের তলায় প্রায় সাত-আটটা ঘর। প্রত্যেকটা ঘরই খালি, আবর্জনাপূর্ণ। দরজাগুলোতে শিকল দেওয়া।
আলো ফেলে ফেলে ঘুরতেই ও দেখতে পেল, উপরে উঠবার সিঁড়ি। আর কালবিলম্ব না করে টর্চটা নিভিয়ে অন্ধকারেই টিপে টিপে নিঃশব্দে ও উপরে উঠতে লাগল।
উপরের তলাতেও ঠিক এমনি একটা বারান্দা। কোণের একটা ঘরের আধ-ভেজানো দরজার ফাঁক দিয়ে খানিকটা আলো এসে বারান্দায় পড়েছে। সুব্রত পা টিপে টিপে দরজাটা দিকে এগিয়ে গেল।
কাদের কথাবার্তার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে যেন।
সুব্রত যে ঘরটা থেকে আলো আসছিল, তার পাশের ঘরটাতে গিয়ে প্রবেশ করল।
ঘরটার এক কোণে একটা সবুজ ঘেরাটোপে ঢাকা বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলছে। ঘরটা খালি! কেউ নেই ঘরে। ভাগ্যক্রমে ও দেখলে, যে-ঘরে লোকগুলো কথাবার্তা বলছিল, সেই ঘর থেকে এই ঘরে আসা-যাওয়ার একটা প্রবেশদ্বার আছে। সেখানে ভারী একটা পর্দা টাঙানো।
সর্বাগ্রে সুব্রত চট্ করে ঘরটার চারপাশে একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলিয়ে নিল।
একপাশে একটা লোহার খাটে শয্যা বিছানো। একটা কাঠের আলমারি এক কোণে দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড় করানো। এককোণে একটা কুঁজো। কুঁজোর মুখে একটা গ্লাস উপুড় করা।
আর এক কোণে একটা লোহার সিন্দুক। একটা আলনায় গোটাকতক কাপড়ও ঝুলছে। সুব্রত আস্তে আস্তে দুই ঘরের মধ্যবর্তী দরজার ঝুলন্ত পর্দার পাশে গিয়ে দাঁড়াল।
পাশের ঘরের লোকগুলো বেশ জোরে-জোরেই কথা বলছে।
একজনের গলা শোনা গেল, একটু কর্কশ গলার স্বর, তাহলে তোমরা চিঠিটা সত্যি উদ্ধার করে এনেছ?
হ্যাঁ, সর্দার। কিন্তু বেটা গোয়েন্দাটা আর একটু হলেই পিস্তলের গুলি চালিয়ে মানকের প্রাণটা নিয়েছিল আর কি!
আগের লোকটি ঐ কথায় কর্কশ গলায় হেসে উঠল।
চিঠিটা যদি আজ তোরা না আনতে পারতিস—লোকটা বলতে লাগল, তবে আজ বহু টাকা আমাদের হাতছাড়া হয়ে যেত। সাবাস! খুব বাহাদুর!
গোবরা জবাব দিলে, তাতে আর সন্দেহ কি সর্দার। তা চিঠির মালিক সেই টাকা দেনেওয়ালা আজ এখানে এসেছিল কি?
না, আমিই সন্ধ্যার সময় তাজ হোটেলে দেখা করেছি। বলেছে, চিঠিটা উদ্ধার হলে কাল এসে সে নিয়ে যাবে।
কিন্তু আমাদের দেনাপাওনার কি হবে সর্দার?
কুছ পরোয়া নেই। টাকা সে আগাম দিয়ে গেছে।
এমন সময় সেই লম্বা লোকটার কণ্ঠস্বর শোনা গেল, তবে এদের টাকা দিয়ে বিদায় করে দাও সর্দার।
হ্যাঁ, টাকা পাশের ঘরের সিন্দুকে আছে। এখুনি এনে দিচ্ছি। ব্যস্ত কেন?
সুব্রত বুঝলে, এখুনি হয়তো সর্দার এ ঘরে আসবে। ও চটপট বড় আলমারিটার পিছনে গিয়ে দাঁড়াল এবং লুকাবার আগেই সে দেখে রেখেছিল ঘরের আলোর সুইচটা কোথায়।
যেখানে লুকিয়েছে তারই পাশে, অনায়াসেই হাত বাড়িয়ে সুইচটা পাওয়া যায়। আর আলমারির পাশেই সিন্দুকটা। একটু পরেই কে যেন এসে ঘরে ঢুকল। সুব্রত আলমারির পিছনে দাঁড়িয়ে পায়ের শব্দ শুনতে পেল।
আগন্তুক এসে সবে চাবি দিয়ে সিন্দুকটা খুলতে যাবে, সহসা সুব্রত এসে তার সামনে দাঁড়াল। হাতে তার উদ্যত পিস্তল।
লোকটার বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে। মোটাসোটা গড়ন। মাথায় ঘন কোঁকড়া চুল। নাকটা চ্যাপটা। চোখ দুটো ছোট ঘোট কুতকুতে। মুখে বিশ্রী বসন্তের দাগ। কুৎসিত।
লোকটা হঠাৎ সুব্রতকে সামনে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় যেন। কিন্তু যেমন সে দাঁড়িয়েছিল তেমনই নীরবে দাঁড়িয়ে রইল।
টু শব্দটি করেছ কী পিস্তলের গুলি তোমার বুকে গিয়ে তোমাকে যমের বাড়ি পাঠাবে।
একটা কুৎসিত হাসির রেখা লোকটার মুখে যেন বিদ্যুৎ-চমকের মতই খেলে গেল।
সুব্রত জানত না যে, যার সামনে সে পিস্তল উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সেই লোকটা কত বড় দুঃসাহসী, নৃশংস ও ভয়ংকর! এর চাইতেও সংকটাপন্ন ভয়ংকর মুহূর্তেও সে তার উপস্থিত বিবেচনা, শক্তি ও সাহস হারায়নি। লোকটা তার কুকুতে ভয়ংকর ধারাল ছুরির ফলার মত দৃষ্টি নিয়ে কিছুক্ষণ স্থিরভাবে সুব্রতর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
তারপর হঠাৎ হ্যাঁ হ্যাঁ করে কর্কশ হাসি হেসে উঠল!
সুব্রত চমকে উঠল, চুপ!
লোকটার কিন্তু ভ্রূক্ষেপও নেই। তেমনিই হা হা করে হাসছে।
সুব্রত আলোটার ওপরে লক্ষ্য করে একটা গুলি চালাল।
ঝন্ঝন্ শব্দ করে মুহূর্তে ঘরটা নিচ্ছিদ্র আঁধারে ভরে গেল।
ইতিমধ্যে ওর হাসি শুনে পাশের ঘরের লোকগুলো অন্ধকার ঘরের মধ্যে ছুটে এসেছে, সর্দার—সর্দার কী হল?
একটা লোক ঘরের মধ্যে!
লোক ঘরের মধ্যে? কোথা থেকে এল? মানকের গলা।
হ্যাঁ, আলমারির দিকে…
সুব্রত ততক্ষণে আলমারির দিক থেকে অন্ধকারে শিকারী বিড়ালের মত দেওয়াল ঘেঁষে এগুচ্ছে দরজার দিকে।
মানকে গম্ভীর গলায় বললে, ওরে শয়তান, শীঘ্র বের হয়ে আয়! সিংহের গুহায় পা দিয়েছিস! বলতে বলতে অন্ধকার তা করে একটা ছুরি ছুঁড়ে মারল মানকে!