দরজাটা হা-হা করছে খোলা। ও বুঝলে সে যখন ঘুমিয়েছিল, তখন এই দরজা খুলেই সুব্রতর ঘরে আততায়ীরা প্রবেশ করেছিল। সুব্রত দরজাটা বন্ধ করে দিল।
আশ্চর্য! কী নিতে ওরা তার ঘরে প্রবেশ করেছিল?
সুব্রত আবার পাশের ঘরে এসে প্রবেশ করল।
ড্রয়ার দুটো তখনও খোলা!
ড্রয়ারের কাছে ও এগিয়ে গেল। অনেক আবশ্যকীয় গোপনীয় কাগজপত্র ওর ড্রয়ারে থাকে।
হঠাৎ আবার ওর নজরে পড়ল একটা ভাঁজকরা কাগজ মেঝেতে পড়ে। একান্ত কৌতূহলবশেই ও সেটা তুলে নিয়ে আলোর সামনে মেলে ধরতেই চমকে ওঠে। একটা চিঠি সেই ডি ভায়োলেট কালিতে সেই হাতে লেখা!
চিঠিটায় লেখা আছে :
মানকে, গোবরা,
আজ রাত্রেই যেমন করে তোক কাজটা শেষ করা চাই। খবর পেয়েছি, সুব্রত হোটেলেই আজ আছে এবং সেটা… ওর ঘরেই অথবা ওর জামার পকেটে নিশ্চয়ই আছে। রক্তক্ষয় বা প্রাণহানির কোন প্রয়োজন নেই। ক্লোরোফরম দিয়েই কাজ সারবে এবং কোন সূত্র রেখে এস না। ঘরে অনায়াসেই ঢুকতে পারবে। …….তোমাদের সাহায্য করবেন।
চাবির ড়ুপলিকেটটা তার কাছে চাইলেই পাবে। আমার নাম করলেই এবং পাস ওয়ার্ডটা বললেই …না নিয়ে কোনমতেই ফিরবে না। উপযুক্ত পারিশ্রমিক পাবে। কাজ শেষ হয়ে গেলে রাত্রি দুটো থেকে সাড়ে তিনটের মধ্যে চিৎপুরের খালসা কেবিনে আমার সঙ্গে দেখা করো। অপেক্ষায় থাকব।
ইতি
১০. সুব্রত তার হাতঘড়িটা
সুব্রত তার হাতঘড়িটা বালিশের তলা থেকে নিয়ে দেখলে তখন রাত্রি প্রায় দেড়টা। কী এখন করে সে? কী তার করা উচিত?
ও দেখলে, মেঝেতে তখন খানিকটা রক্ত জমে আছে। ও বুঝতে পারল লোক দুটোর মধ্যে একজন নিশ্চয়ই তার পিস্তলের গুলিতে আহত হয়েছে।
হয়তো গুরুতরভাবে আহত হয়নি, পালিয়ে যেতে পেরেছে যখন। এ বিষয়ে কোন সন্দেহই নেই।
কিন্তু চিঠির মধ্যে ঐ ডট্-গুলোর অর্থ কী? চকিতে ওর একটা কথা মনে পড়ে গেল। তবে কী—হ্যাঁ, তিনটে ডট মানে চিঠিটা। চিঠিটা ও ড্রয়ারেই রেখেছিল দুপুরের দিকে।
তাড়াতাড়ি ও ড্রয়ারের কাগজপত্রগুলো ঘাঁটতে শুরু করল। না, চিঠিটা নেই। চিঠিটা খুনী চুরি করলে কেন?
প্রমাণ—তার বিরুদ্ধে এটা একটা প্রমাণ। তাই চিঠিটা সরাবার প্রয়োজন হয়েছিল?
কিন্তু কেন সে তখন সাবধান হল না? কেন সে এই ড্রয়ারের মধ্যে চিঠিটা রেখেছিল?
কিন্তু চিঠির মধ্যে ছয়টি ডটের মানে কী? নিশ্চয়ই কোন লোকের নাম হবে যার নিকট হতে পত্রবাহক মানকে ও গোবরাকে তার ফ্ল্যাটে ঢুকতে না পারলে সাহায্য নিতে বলেছে? চাবির ড়ুপলিকেটও তার কাছেই পাওয়া যাবে। কিন্তু কার কাছ হতে তার এই ফ্ল্যাটের চাবির ড়ুপলিকেট পাওয়া সম্ভব?
একমাত্র হোটেলের ম্যানেজারের। কী তার নাম? ঠিক। তার নাম কামতাপ্রসাদ! হ্যাঁ, ছয়টি ডট! তাহলে মিলে যাচ্ছে। হুঁ, কামতাপ্রদাসই তাহলে তার শত্রুদলকে সাহায্য করেছে!
একটা ব্যাপার কিন্তু স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে, প্রকাণ্ড একটা ষড়যন্ত্র আছে মিঃ সরকারের এই খুনের ব্যাপারে। কোন একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি টাকার সাহায্যে অন্য লোকের দ্বারা এইসব কাজ চালাচ্ছে। একটা দল সঙ্বদ্ধভাবে কাজ করছে। তাছাড়া চিঠির প্রথম তিনটি ডট যদি চিঠিটা বলে ধরা যায়, চিঠির শেষ তিনটি ডটয়েরও একই বিশ্লেষণ দাঁড় করানো যেতে পারে। কিন্তু আর এখানে বসে থাকলে তো হবে না। এখুনি একবার চিৎপুরে খালসা হোটেলে যেতে হবে। দেখা যাক, সেখানে যদি কিছুর সন্ধান মেলে।
সুব্রত চটপট জামা বদলে সাধারণ লোকের মত সাজসজ্জা করে নিল।
মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চোখের কোলে কালি। মাথার চুল রুক্ষু, গায়ে সাধারণ একটা ছেড়া ডোরাকাটা টুইলের শার্ট।
পরিধানে মলিন একখানা ধুতি। পায়ে ক্যাম্বিসের জুতো।
সুব্রত তার ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে হোটেল থেকে বের হয়ে নীচের রাস্তায় এসে দাঁড়াল।
মাথার উপরে রাত্রির কালো আকাশ। অসংখ্য তারার মিটিমিটি চাউনি যেন। সমগ্র বিশ্বচরাচর নিদ্রার কোলে ঢলে পড়েছে।
কেউ কোথাও নেই।
ধর্মতলার মোড় থেকে একটা ট্যাক্সি ধরে ড্রাইভার নির্জন রাস্তা পেয়ে ঝড়ের বেগে গাড়ি ছুটালে।
সুব্রত চলমান গাড়ির মধ্যে ব্যাকসিটে হেলান দিয়ে বসে চোখ বুজল।
চিৎপুরের রাস্তাটা বিডন স্ট্রীটের সঙ্গে যেখানে এসে মিলেছে, তারই সামনে খালসা কেবিন।
খালসা কেবিনের সামনে ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিয়ে সুব্রত ভাড়া মিটিয়ে দিল এবং তাকে সেখানেই অপেক্ষা করতে বললে।
কেবিনের মধ্যে উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলছে।
মস্তবড় উনুনটা গল্প করে জ্বলছে। উনুনের ওপরে শিক কাবাব তৈরি হচ্ছে। পাশেই একটা মস্তবড় লোহার কেলিতে বোধ করি চায়ের জল ফুটছে।
ভেতরে কতকগুলো টেবিল ও টিনের চেয়ার পাতা।
দশ-বারোজন নিম্নশ্রেণীর কুলী, মজুর ও গাড়োয়ান বসে চা পান করছে।
ঘরের দেওয়ালে কতকগুলি কুৎসিত ছবি টাঙানো।
কাউন্টারের একপাশে দাড়িগোঁফওয়ালা একজন মোটামত লুঙ্গি পরা মুসলমান বসে বসে বিড়ি ফুঁকছে।
একটা গ্রামোফোনে রেকর্ড বাজছে।
তুমকো মোবারক হো
উঁচে মাহলিয়া—
হামকো হায় পিয়াসী
হামারি গলিঁয়া।
পাশেই একটা কাঁচের আলমারিতে ডিশে সাজানো ডিমসিদ্ধ, ডিমের কারি, মাংসের কারি আর পরোটা।
সুব্রত এসে হোটলে প্রবেশ করে এক কাপ চা দিতে বলে। তারপর একটা লোহার চেয়ারে বসে একটা বিড়ি ধরালো।
একটা ছোকরা এসে ময়লা কাপে এক কাপ চা দিয়ে গেল।
সুব্রত চা খেতে খেতে ঘন ঘন রাস্তার দিকে তাকাতে লাগল। কিছুক্ষণ বাদেই ও দেখলে, দুজন লোক এসে কেবিনে প্রবেশ করল। একজন একটু লম্বা। অন্যজন একটু বেঁটে। দুজনের দেহই বেশ গাঁট্টাগোট্টা, বেঁটে লোকটার হাতে একটা পট্টি বাঁধা। পউিটার খানিকটা রক্তে লাল হয়ে উঠেছে।