সুব্রত নির্দেশমত চেয়ারে উপবেশন করল।
সুব্রতই প্রথমে কথা শুরু করলে, আমার পরিচয়টা আগেই দেওয়া ভাল মিঃ দত্ত। আমি সি. আই. ডি.-র লোক। ব্যাঙ্কার ও জুয়েলার মিঃ সরকারের খুনের তদন্ত আমি করছি।
সুবোধবাবু নির্বিকারভাবে প্রশ্ন করলেন, কি চাই আপনার আমার কাছে?
কয়েকটি কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করতে চাই। আশা করি, যথাযথ উত্তর পাব। সুবিমল চৌধুরী নামে কোন ভদ্রলোককে আপনি চেনেন? মহালক্ষ্মী ব্যাঙ্কে চাকরি করেন। শুনলাম, তিনি আপনার বিশেষ বন্ধু। বহুকালের জানাশোনা আপনাদের।
সুব্রত স্পষ্ট লক্ষ্য করলে, সুবোধবাবুর মুখখানা যেন সহসা একটু গম্ভীর হয়েই তখুনি আবার প্রশান্ত ও নির্লিপ্ত ভাব ধারণ করল, সামান্যই তার সঙ্গে জানাশোনা। তাও কিছুদিন আগে ছিল, এখন আর নেই।
ওঃ। আচ্ছা আপনি তাকে কখনও চায়না থেকে আনা চায়নীজ ভায়োলেট রংয়ের একটি কালির শিশি উপহার দিয়েছিলেন কি?
প্রথম কথা, জীবনে আমি চীনে কোনদিনই যাইনি। দ্বিতীয়, আপনার বর্ণনামত কোন কালির শিশিই তাকে উপহার দিইনি।
দেননি!
না। ভদ্রলোক গম্ভীরভাবে জবাব দিলেন।
কিন্তু তিনি যে সেই রকম কথাই আজ সকালে আমায় বললেন!
তিনি যদি বলেই থাকেন যে আমি তাঁকে কালিটা দিয়েছি, সেটাই সত্য হবে, আর আমার কথাটা মিথ্যে হয়ে যাবে?
না, তা নয়। তবে—
আচ্ছা, তিনি বলছিলেন, আপনারা দুজনে ছোটবেলার বন্ধু ছিলেন?
না, কস্মিকালেও নয়। ছোট সংক্ষিপ্ত জবাব।
এরপর একপ্রকার বাধ্য হয়েই সুব্রতকে উঠতে হল।
আশ্চর্য! এভাবে সুবিমলবাবুর মিথ্যা কথা বলবার কি প্রয়োজন ছিল?
সেরাত্রে সুব্রত আর বাড়িতে ফিরল না। সোজা মমতাজ হোটেলের দিকেই চলল। সমগ্র ব্যাপারটা যেন আগাগোড়া কেমন জটিল হয়ে উঠছে।
চিঠিটা সত্যি তবে তাকে কে লিখল? সুবিমলবাবুর হাতের লেখার মতই অবিকল হাতের লেখা। অথচ সে কথাটা স্বীকার করল না কেন?
ঠিক ঐ রংয়ের কালিও তার কাছে আছে। অথচ যে জায়গা থেকে সে কালিটা পেয়েছে বললে, সেটা দেখা যাচ্ছে মিথ্যা!
কাকে সে বিশ্বাস করবে? কোন্ সূত্র ধরে কোন্ পথে ও এখন চলবে?
সুব্রত হোটেলে যখন ফিরে এল রাত্রি তখন প্রায় নয়টা।
অসহ্য ক্লান্তিতে সর্বশরীর অবসন্ন।
বিশ্রামের একান্ত প্রয়োজন।
ফ্ল্যাটে ফিরে প্রথমেই সে বাথরুমে ঢুকে অনেকক্ষণ ধরে ঠাণ্ডাজলে স্নান করলে।
শরীর যেন অনেকটা ঠাণ্ডা হল।
হোটেল থেকে ও ডিনার আনিয়ে খেল।
***
রাত্রি তখন বোধ করি একটা বেজে গেছে।
সুব্রত ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। কিন্তু ঠিক কতক্ষণ যে ঘুমিয়েছিল তাও বলতে পারে না।
হঠাৎ তার ঘুমটা ভেঙে গেল।
অন্ধকার ঘর।
ঘরের নিঃশব্দ অন্ধকারের মধ্যে যেন একটা অস্পষ্ট শব্দ। যেন কে বা কারা ঠিক পাশের ঘরেই নিঃশব্দ পদসঞ্চারে চলে-ফিরে বেড়াচ্ছে।
নাকের ওপরে একটা যেন নরম তুলোর মত স্পর্শ। অথচ কী ভারি মিষ্টি একটা গন্ধ! যেন শ্বাস নিতে কষ্ট বোধ হচ্ছে।
হঠাৎ সে হাত দিয়ে মুখের উপর থেকে টান মেরে কি একটা মেঝেতে ফেলে দিল।
বুঝতে পারলে কেউ তার মুখের ওপরে একটা ক্লোরোফরম স্পঞ্জ দিয়েছিল।
তাড়াতাড়ি ও উঠে বসল।
নিকষ কালো অন্ধকার ঘরের মধ্যে যেন জমাট বেঁধে উঠল।
প্রথমটায় ও কিছুই দেখতে পেল না।
তারপর একটু একটু করে অন্ধকারটা চোখ থেকে সরে গেল। দুঘরের ভাঁজ করা দরজার ঈষৎ ফাঁকে একটা অস্পষ্ট মৃদু আলোর আভাস। বুঝলে, কেউ ওর ফ্ল্যাটে এসেছে।
সুব্রত বিছানা থেকে নিঃশব্দে উঠে পড়ল।
মাথাটার মধ্যে তখনও কিন্তু ঝিঁঝিম্ করছে। বালিশের তলা থেকে সাইলেন্সার দেওয়া রিভলভারটা নিয়ে ও পায়ে পায়ে নিঃশব্দে দরজাটার দিকে এগিয়ে গেল। দরজার ফাকে চোখ রাখতেই ও ভয়ংকর রকম চমকে উঠল। দেখলে, সবুজ ঘেরাটোপ ঢাকা টেবিল ল্যাম্পটা জ্বলছে।
ঘরের মধ্যে দুজন মুখোশধারী লোক! তারা সুব্রতর সিক্রেট ড্রয়ার হাতড়াচ্ছে। কিন্তু সুব্রতর মাথা থেকে ক্লোরোফরমের আমেজটা তখনও যায়নি। হঠাৎ মাথাটা কেমন একটু ঘুরে উঠতেই ও সামলে নিতে গিয়ে ওর হাতের ধাক্কায় সশব্দে দরজাটা খুলে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে লোক দুটো খোলা জানলাপথে পালাবার চেষ্টা করলে। এবং চকিতে ওদের মধ্যে একজন হাত বাড়িয়ে। সুইচ টিপে আলোটা নিভিয়ে দিল।
অন্ধকার। নিচ্ছিদ্র আঁধার।
সুব্রত তবু শব্দ ও দিক লক্ষ্য করে রিভলবারের ট্রিগার টিপল। নিঃশব্দে একটা আগুনের ঝিলিক সাঁ করে অন্ধকারের বুকে ছুটে মিলিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে একটা চাপা আর্তনাদ।
সুব্রত ততক্ষণে আবার সামলে উঠে দাঁড়িয়েছে।
সুব্রত তড়িৎপদে অন্ধকার ঘরের মধ্যে শব্দ ও আর্তনাদ লক্ষ্য করে ঢুকে পড়ল।
যে লোকটা আহত হয়েছিল, তারই ঘাড়ের উপর সুব্রত অন্ধকারে হুমড়ি খেয়ে পড়ল।
হুমড়ি খেয়ে পড়তেই লোকটা অন্ধকারে সুব্রতকে জাপটে ধরে।
তখন শুরু হল দুজনে ঝটাপটি।
লোকটার গায়ে বেশ শক্তি আছে। তথাপি সুব্রত তখন তাকে প্রায় ঘায়েল করে এনেছে, তখন মাথার ওপরে কে একটা প্রচণ্ড ঘূষি বসিয়ে দিল সুব্রতর। সুব্রতর মাথাটা ঝিমঝিম্ করে এল, হাতের মুঠি শিথিল হয়ে গেল।
চোখের পলকে লোকটা সুব্রতর কবল হতে নিজেকে মুক্ত করে নিল এবং দ্রুতপদে সুব্রতর শয়নঘরের দিকে পালিয়ে গেল।
সুব্রত আবার নিজেকে ভাল করে সামলাবার আগেই লোক দুটো অদৃশ্য হয়ে গেল।
প্রথমে সুব্রত ঘরে আলোটা জ্বালাল।
কিন্তু ঘর তখন খালি।
অতঃপর সুব্রত শয়নঘরে এসে ঢুকল। শয়নঘরটাও খালি।