লোকটাকে তুই চিনতে পারিসনি, সত্যি বলছিস্?
সত্যি।
লোকটা লম্বা না বেঁটে?
আজ্ঞে লম্বা।
আচ্ছা তুই যা!
গোপাল কাঁপতে কাঁপতে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
সুব্রত তখন অন্য চাকরদের ও দারোয়ান, ড্রাইভার সকলকে একে একে ডেকে প্রশ্ন করতে লাগল।
কিন্তু কারও কাছে আর তেমন বিশেষ কোন সন্ধান বা সূত্র পাওয়া গেল না।
কিরীটী যখন সিঁড়ি দিয়ে নেমে নীচে বাইরের ঘরে এল, দেখলে বাইরের ঘরে একটা সোফায় মাথায় হাত দিয়ে নিঝুম ভাবে বসে আছে বিনয়ে। কিরীটী নিঃশব্দে বিনয়েন্দ্রের সামনে এসে দাঁড়াল, বিনয়! বিনয়ে চমকে মুখ তুলল। তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পার বিনয়। এ রহস্যের কিনারা আমি করবই!
বিনয়ে অশ্রুভরা কণ্ঠে বললেন, আমার দাদা দেবতার মত, ঋষির মত দাদা। আমি তো ভাবতেই পারছি না কিরীটী, কে এই সর্বনাশ আমাদের করতে পারে?
কাউকেই তোমার সন্দেহ হয় না, বিনয়?
না।
কিরীটী কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর হঠাৎ মৃদু চাপা সুরে বললে, মনে হচ্ছে ব্যাপারটা খুব জটিল নয়।
কিছু বুঝতে পারলে ভাই?
পেরেছি বই কি। খুনীকে মনে হচ্ছে হয়তো বুঝতে পেরেছি। তবে motive যেন এখনও তেমন strong বলে মনে হচ্ছে না।
তুমি জান? জান কে খুনী? উদ্বেগাকুল কণ্ঠে বিনয়ে প্রশ্ন করলেন।
কিরীটী অদ্ভুত একপ্রকার হাসি হাসতে হাসতে বললে, জানি বৈকি!
০৯. নিজের আমহার্স্ট স্ট্রীটের বাসায়
নিজের আমহার্স্ট স্ট্রীটের বাসায় ও লালবাজারের অফিসে অনেক সময় নানা অসুবিধা হয় বলে সুব্রত মাস দুদিন হল চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনুতে মমতাজ হোটেলের দোতলায় একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে।
হোটেলের ফ্ল্যাটটি সুব্রত নিজের নাম ভাড়া নেয়নি। ওখানে তার নাম অমিতাভ রায়। শেয়ার মার্কেটের দালাল বলে পরিচিত সেখানে সে।
মিঃ সরকারের সার্কুলার রোডস্থিত মর্মরাবাস থেকে বের হয়ে সুব্রত গাড়ি চালিয়ে বরাবর আমহার্স্ট স্ট্রীটের বাসায় ফিরে এল।
ঘণ্টাখানেক বাদে কিছু খেয়ে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি থেকে বের হয়ে সোজা গিয়ে হ্যারিসন রোড অভিমুখে একটা ট্রামে চেপে বসল।
***
সুব্রত যখন মমতাজ হোটেলে তার ফ্ল্যাটে এসে প্রবেশ করল, বেলা তখন প্রায় দেড়টা হবে। শীতের রৌদ্রে নীলাকাশ যেন ঝলসে যাচ্ছে।
হোটেলটা একেবারে বড় রাস্তার উপরে।
সুব্রত পকেট থেকে চাবি বের করে দরজা খুলে নিজের ঘরে গিয়ে প্রবেশ করল।
ছোট ঘোট তিনখানি ঘর পাশাপাশি! একখানা ঘর শয়নকক্ষ। সেই ঘরে একটা ক্যাম্প খাটে ধোপদুরস্ত নিভাঁজ শয্যা বিছানো। দুখানা সোফা।
আর আছে একটি বুক-সেলফ। বুক-সেফের পাশেই একটি উঁচু টেবিল স্ট্যান্ডের ওপরে ছোট একটি দামী রেডিও সেট! এবং একটি আলমারিতে কিছু কাপড়জামা।
পাশের ঘরটি একটু বিচিত্র।
দু পাশের দেয়ালে দুটি দামী প্রমাণসাইজের আয়না টাঙানো। পাশেই একটি র্যা। তাতে নানা প্রকারের সব বেশভূষা ঝুলছে। পাশেই একটি টেবিলে নানা ধরনের ছোটবড় শিশি। নানা প্রকার ক্রীম, পাউডার। তাছাড়া নানা ধরনের পরচুলা, স্পিরিটগাম, ছুরি, কাঁচি প্রভৃতিও টেবিলের ওপরে সাজানো।
অবশ্য সুব্রতর আমহার্স্ট স্ট্রীটের বাড়িতেও ঐ ধরনের আর একপ্রস্থ সাজ-সরঞ্জাম মজুত আছে।
এই ঘর থেকে সে মাঝে মাঝে গভীর রাতে কখনও ভিখারির বেশে, কখনও গাড়োয়ান, কখনও ঝকামুটে, কখনও ট্যাশ ফিরিংগি, কখনও অন্ধ, কখনও বা খঞ্জ প্রভৃতি নানা প্রকারের ছদ্মবেশে অভিযানে বের হয়।
মমতাজ হোটেলের ম্যানেজার একজন মাড়োয়ারী ভদ্রলোক। তিনি সুব্রতর আসল পরিচয়টা জানেন।
দালালবেশী সুব্রতর বেশ অন্য ধরনের। মাথার সামনের দিকে একটুখানি টাক।
ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, ছুঁচালো পাকানো গোঁফ। চোখে কালো কাঁচের গগলস্।
এই বেশে সুব্রতকে চেনারও উপায় নেই।
সুব্রত কলিং বেলটা টিপে চেয়ারের ওপরে বসল একটা কাগজ-পেনসিল নিয়ে। আজকের সকালের সমস্ত ঘটনাগুলি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিবেচনা করলে দুটো জিনিস সহজেই চোখে পড়ে।
এক নং, মিঃ সরকারকে এমন কোন ব্যক্তি খুন করেছে যে ও বাড়িতে বিশেষ পরিচিত। ও বাড়ির খুঁটিনাটি সব কিছুই তার নখদর্পণে। বাইরের কোন তৃতীয় ব্যক্তি নয়। দু নং, ও বাড়ির প্রত্যেকেরই সমান, মোটিভ বর্তমান।
দরজায় এসে ভৃত্য নক্ করলে।
ভিতরে এস, সুব্রত বললে।
হোটেলের একজন ভৃত্য ঘরে এসে সেলাম দিয়ে দাঁড়াল।
এক কাপ চা পাঠিয়ে দাও।
ভৃত্য চলে গেল।
সুব্রত কাগজটার উপরে আবার পেনসিল দিয়ে লিখতে শুরু করলে :
প্রত্যেকের নাম সন্দেহ কোন্ কোন্ ব্যক্তিকে করা যায়
১০ নম্বর
খুন করা কার কার পক্ষে সম্ভব ছিল?
১০ নম্বর।
উদ্দেশ্য বা Motive
১০ নম্বর
Alibi
১০ নম্বর
খুন করা সম্ভব এমন দেখতে কি?
সবসমেত নম্বর
১। মিঃ সরকারের ছোট ছেলে সৌরীন্দ্র মৃত ব্যক্তির ঠিক পাশের ঘরেই ছিল। অনায়াসে সে খুন করার সুযোগ পেতে পারে, তাছাড়া তার বাপের সঙ্গে টাকার ও উইলের ব্যাপার নিয়ে সেদিন রাত্রে ঝগড়া হয়ে গিয়েছিল।
৮
রাগের মাথায় খুন করা সম্ভব ছিল। এবং সে তার বাপকে শাসিয়েও ছিল।
৮
টাকা
বাপ মারা গেলে সে উইলের টাকা পেত।৮ কোন কিছুই ছিল না, সারারাত্রি সে পাশের ঘরের ছিল।
৯
তেমন কিছু দেখতে নয়।
৬
৩৯
২। ভাগ্নে অশোক স্বীকার করেছে সে, সে রাত্রে মৃত ব্যক্তিকে একটা antitetanus injection; কিন্তু প্রথমে সেকথা স্বীকার করেনি কেন? সন্দেহজনক।
১০