তোমার বাড়ি কোথায়?
আজ্ঞে কর্তা এই বাংলা দেশেই–বর্ধমান জিলার মেমারি গ্রামে।
সংসারে তোমার কে আছে?
কেউ নেই। ছোট বয়সে মা-বাপকে খেয়েছি। এক দূরসম্পর্কীয় কাকার কাছে মানুষ!
কতদিন এ বাড়িতে আছ?
তা আজ্ঞে আঠার বছর—
বাবু তোমাকে খুব ভালবাসতেন, তাই না রামচরণ?
আজ্ঞে হ্যাঁ। রামচরণের চক্ষু অশ্রুসজল হয়ে উঠল।
হঠাৎ এমন সময় কিরীটী একটি প্রশ্ন করল, রামচরণ, তোমার কর্তার ঘুম খুব পাতলা ছিল, না গভীর ছিল?
আজ্ঞে কর্তা খুব কম সময়েই ঘুমাতেন। তবে যতক্ষণ ঘুমোতেন, গভীর ঘুমই হত।
ওঃ! আচ্ছা সুব্রত, তুই যা জিজ্ঞাসা করছিলি আবার কর?
সুব্রত আবার তার জবানবন্দি শুরু করল।
কালকের সন্ধ্যার পর থেকে আজকের সকাল পর্যন্ত ঘটনা আমাকে এতটুকুও গোপন না করে খুলে বলতে পার রামচরণ?
রামচরণ তখন বলতে লাগল, কর্তাবাবু আমাদের দেবতার মত লোক ছিলেন বাবু। চাকর হলেও আজ আঠার বছরের মধ্যে কখনও একটা উচু করে কথা বলেন নি। কাল বিকালে ছয়টার সময় যখন ব্যাংক থেকে বাড়ি ফিরে এলেন, আমি তার ঘরে জামাকাপড় খুলে দিতে গিয়েছিলাম। দেখলাম বাবুর মুখটা যেন গম্ভীর। আজ আঠার বছর বাবুকে দেখছি, বুঝলাম কিছু একটা ঘটেছে যার জন্য কর্তাবাবু গম্ভীর হয়ে আছেন। কেননা বরাবরই দেখেছি, কোন কারণে কর্তাবাবু অসন্তুষ্ট হলে বা রাগ করলে গম্ভীর হয়েই দুতিনদিন থাকতেন। কারও সঙ্গে বড় একটা কথাবার্তা বলতেন না। বাবু চিরকালই একটু গম্ভীর প্রকৃতির ও চাপা ছিলেন। চেঁচামেচি বড় একটা কোনদিনই করতে শুনিনি। বাবু আমাকে বললেন, রামচরণ, শরীরটা আজ আমার খারাপ, কেউ যেন বিরক্ত না করে। আজ আর কিছু খাব না। রাত্রে শুধু এক গ্লাস গরম দুধ দিয়ে যাস। রাত্রি দশটার সময়।
তারপর?
তারপর রাত্রি দশটার সময় যখন দুধ নিয়ে আমি..রামচরণ বলতে বলতে হঠাৎ যেন থেমে গেল।
হ্যাঁ, বল। গরম দুধ নিয়ে যখন যাও—তারপর?
ছোট দাদাবাবু মানে কর্তার ছোট ছেলে তখন লাইব্রেরিতে কর্তার সঙ্গে কথা বলছিল—
হঠাৎ এই সময় কিরীটী তীক্ষ্ণস্বরে প্রশ্ন করলে, তাদের কথা তুমি চুপিসাড়ে শুনতে চেষ্টা করেছিলে রামচরণ…বল, কি তুমি শুনেছ?
বাবু, আমি গরিব চাকরবাকর মানুষ রামচরণ ভেঙে পড়ল।
কিন্তু আড়ি পেতে শোনা তোমার অভ্যাস রামচরণ। কিরীটী বললে, কিন্তু কি শুনেছিলে?
আজ্ঞে ক্ষমা করবেন বাবু, আমার যেন মনে হল বাবু ছোট দাদাবাবুকে বেশ একটু জোর গলাতেই বলছেন, তুমি জাহান্নামে গেছ—একেবারে গোল্লায় গেছ হতভাগা। আমি শীঘ্রই নতুন। উইল করব। একটি পয়সাও তোমাকে দেব না। অপদার্থ! দুটো ছেলেই আমার অপদার্থ। একঘর কুলাঙ্গার নিয়ে আমি বাস করছি।
ছোটবাবু কি জবাব দিলেন তাতে? সুব্রত প্রশ্ন করলে।
মনে হল ছোটবাবুও যেন রেগে বললেন, বুড়ো হয়ে তোমার ভীমরতিতে ধরেছে। উইল যাতে তোমাকে আর না বদলাতে হয়, সে ব্যবস্থাও আমি করছি। বলতে বলতে ছোটবাবু যেন। একপ্রকার ঝড়ের মতোই হঠাৎ দরজা খুলে আমায় পাশ কাটিয়ে এ ঘর থেকে বের হয়ে চলে গেলেন। নিজের ঘরের দিকে।
তারপর?
তারপর আমি দুধ নিয়ে ঘরে গিয়ে ঢুকলাম। কর্তাবাবু আমাকে দুধের গ্লাসটা শোবারঘরের টেবিলের ওপরে রেখে চলে যেতে বললেন।
হঠাৎ আবার কিরীটী প্রশ্ন করলে, রামচরণ, তোমার বাবু কি সব সময়েই ঘড়ি হাতে দিয়ে থাকতেন?
আজ্ঞে বাবু অনেক রাত্রি পর্যন্ত পড়াশুনা করতেন লাইব্রেরি ঘরে। যতক্ষণ না শুতে যেতেন ঘড়িটা হাতেই থাকত। অনেক সময় ঘড়ি হাতেই বাঁধা থাকত, শুয়ে পড়তেন।
হুঁ। তোমার বাবু কি রাত্রে কখনও তোমাকে ডাকতেন?
আজ্ঞে না। তবু সর্বদাই আমি সজাগ থাকতাম। অন্তত যতক্ষণ না তিনি শুতে যান। তবে কাল। রাত্রি যখন দেড়টা, হঠাৎ একটা শব্দ শুনে আমার ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম আমার চিরদিনই পাতলা। শব্দটা শুনে প্রথমটা বুঝতে পারিনি। ঘুমের ভাব তখনও চোখে লেগে ছিল। ভাবছি কি করব। তারপর সাতপাঁচ ভেবে উঠে এসে এই ঘরের দরজায় ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। দেখলাম বাবু এখনও ঘুমোতে যাননি। উঁকি মেরে দেখলাম, তখনও বাবু চেয়ারের ওপরে পিছন ফিরে বসে আছেন। সামনে বই খোলা, ঘরে আলো জ্বলছে। বুঝলাম বাবু তখনও পড়ছেন। তাই আবার দরজা ভেজিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম।
কিরীটী আবার প্রশ্ন করলে, তোমার বড়দাদাবাবু সব শেষ কবে এ বাড়িতে এসেছিলেন রামচরণ?
আজ্ঞে কেন, কালই তো রাত্রে এসেছিলেন!
সুব্রত যেন ভয়ংকর রকম চমকে উঠে বললে, কাল রাত্রে এসেছিলেন? কখন?
আজ্ঞে রাত্তির তখন এগারোটা হবে। নীচের দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছি, এমন সময় বড় দাদাবাবু দরজায় ধাক্কা দিলেন–
তারপর?
তারপর আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কর্তাবাবু জেগে আছেন কিনা? তিনি তার সঙ্গে দেখা করতে চান। আমি বললাম, কর্তাবাবু জেগে আছেন বটে, তবে তার শরীর খারাপ। তখন তিনি। বললেন, তবে থাক—একটা জরুরি কাজে এসেছিলাম বাবার সঙ্গে দেখা করতে, কিন্তু তার শরীর যখন খারাপ, থাক কাল সকালেই আসব না হয়, বলে তিনি চলে গেলেন। আমিও দরজা বন্ধ করে উপরে চলে এলাম।
কিরীটী মৃদু গম্ভীর স্বরে বললে, হুঁ, টিকিটের কাউন্টার-পার্ট!
০৮. তালুকদারের মুখের দিকে চেয়ে
তালুকদারের মুখের দিকে চেয়ে সুব্রত বললে, অশোকবাবুকে আর একবার ডাকা দরকার!
তালুকদার অশোকবাবুকে ডাকবার জন্য আর একজনকে পাঠিয়ে দিল।
কিরীটী ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। সুব্রতর মুখের দিকে তাকিয়ে কিরীটী বললে, আমি তাহলে চললাম সু। সন্ধ্যার দিকে একবার আসিস। যদি নতুন কোন কিছু এর মধ্যে জানতে পারিস—তাছাড়া তোর সঙ্গে এ কেসটা সম্পর্কে আলোচনাও করা যাবে।