অশোকবাবু সম্পর্কে আপনার ধারণা কি রকম?
অশোক বড় ভাল ছেলে। দাদা তাকে ছেলের মতই ভালবাসতেন।
আপনার দাদার উইল সম্পর্কে আপনার কোন ধারণা আছে?
কানাঘুষায় শুনেছি, দাদার সম্পত্তি দুভাগে ভাগ করা হবে। অর্ধেক public donation-এ। যাবে। বাকি অর্ধেক সমান ভাগে আমি, অশোক, সৌরীন ও সুবিমল পাব।
কাউকে আপনি আপনার দাদার হত্যাকারী বলে সন্দেহ করেন?
সুব্রতর কথায় বিনয়েবাবু কিছুক্ষণ গুম হয়ে চুপ করে বসে রইল। তারপর ধীরস্বরে বলল, না।
০৭. এমন সময় কিরীটী ওদের সামনে
এমন সময় কিরীটী ওদের সামনে এগিয়ে এল, একটা জিনিস লক্ষ্য করেছিস সুব্রত?
সুব্রত মুখ তুলে কিরীটীর দিকে তাকাল, কি?
মৃত ব্যক্তির বাঁ হাতের কড়ে আঙুলে একটা ছোট্ট পট্টি জড়ানো!
বিনয়েন্দ্রবাবু সঙ্গে সঙ্গে বলেন, গতকাল সকালে কাঁচের গ্লাসে দুধ খেতে গিয়ে দাদার হাত থেকে কাঁচের গ্লাসটা পড়ে ভেঙে যায়। ভাঙা কাঁচের টুকরো টেবিল থেকে সরাতে গিয়ে দাদার বাঁ হাতের কড়ে আঙুলটা কেটে যায়। আমি তখন দাদার সামনেই দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম।
কিরীটী শুধু মৃদুস্বরে বললে, হুঁ।
সুব্রত তখন বিনয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, আপনি এখন যেতে পারেন বিনয়বাবু। অনুগ্রহ করে মিঃ সরকারের ভৃত্য রামচরণকে একটিবার পাঠিয়ে দিন।
বিনয়ে ধীরভাবে ঘাড় হেলিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।
কিরীটী আবার বললে, সব ঘুরে দেখলাম, সু। একটা জিনিস বুঝতে পারছি না।
কি?
মিঃ সরকারের শয়নঘরের সংলগ্ন ঘোরানো লোহার সিঁড়ির সামনের ঘরের মধ্যে যাতায়াত করবার দরজাটা বন্ধ কেন?
ওটা তো শুনলাম সব সময়ই বন্ধ থাকে। মেথর ঐ ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে উঠে ঘরের পিছনের বারান্দা দিয়ে বাথরুমে যাতায়াত করে।
সব সময় বন্ধ থাকলেও আজ তো বন্ধ থাকার কথা নয়। বড় গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। কেন বন্ধ আছে দরজাটা?
কি তুই বলতে চাস কিরীটী?
বলতে চাই দরজাটা বন্ধ কেন? কেন—কেন ওটা বন্ধ থাকবে? তাছাড়া আরও একটি। ব্যাপার, মিঃ সরকারের হাতঘড়িটা ভাঙল কি করে? ভাঙার তো প্রয়োজন ছিল না? দুটোর সময় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাই বলে ভাঙবে কেন?
সুব্রত কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বললে, হয়তো পড়ে গিয়ে ভেঙেছে। কিন্তু
এর মধ্যে আবার কিন্তু কি? পড়েই বা যাবে কেন?
সুব্রত কিরীটীর ব্যবহারে এবার যেন একটু বিরক্তই হল, বললে, কিরীটী! আরও একটা কথা আছে, বিনয়বাবুর সামনে আমি সে কথা বলিনি—এই 5 c.c. সিরিঞ্জটা অশোকবাবুর ঘরে ল্যাবরেটারির টেবিলের উপর পাওয়া গেছে।
কিরীটী সুব্রতর হাত থেকে সিরিঞ্জটা নিয়ে একবার ঘুরিয়ে দেখল, হ্যাঁ, Needle বড় সাইজের এবং মোটাও। অনায়াসেই এটা ফুটিয়ে হার্ট puncture করা যায়। আর punctureটাও fifth intercostal space-এ left mamary line-এর laterally ও below-তাতে মনে হয় ভদ্রলোকের enlarged heart ছিল। যদি অবিশ্যি heart-এ puncture করেই হত্যা করা হয়ে থাকে! সিরিঞ্জের মধ্যে জমাটবাঁধা রক্তটা analysis করলে কিছু সন্ধান পাওয়া যেতে পারে–বলতে বলতে সিরিঞ্জটা আবার কিরীটী সুব্রতর হাতে ফিরিয়ে দিল।
কিছু বুঝতে পারলি? সুব্রত আবার প্রশ্ন করল কিরীটীকে।
মৃত ব্যক্তির চেয়ারের positionটা দেখ—এমনভাবে চেয়ারটা place করা-যে কেউ ঐ ব্যালকনির খোলা দরজা দিয়ে বা শয়নঘর থেকে এই লাইব্রেরি ঘরে প্রবেশ করলে মিঃ সরকারের তা জানবার উপায় ছিল না। কিন্তু তা তো নয়, আমি ভাবছি অন্য কথা! মৃত ব্যক্তি চেয়ারে না বসে থেকে শোবার ঘরে খাটের ওপরেই শুয়ে থাকলেই বা কি এমন ক্ষতি ছিল?
কিরীটীর কথাগুলো আজ যেন কেমন-কেমন মনে হয় সুব্রতর।
অদ্ভুত বুদ্ধিপ্রাখর্যে যে চিরদিন সজাগ, তার মুখে আজ এসব কি আবোল-তাবোল কথা? ঘড়িটা ভাঙা কেন? দরজাটা বন্ধ কেন? মৃত ব্যক্তি চেয়ারে বসে কেন? সুব্রত আর একবার কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।
হঠাৎ আবার কিরীটী বলে উঠল, বুঝলি সু, ভাঙা ঘড়ি আর চেয়ারে বসা এ দুটো ব্যাপার যেন কিছুতেই মেলাতে পারছি না।
কিন্তু ঘড়িগুলো যে দুটোর সময় বন্ধ হয়ে গেল? সকলের ঘড়িই!
Quite possible-সোজা! খুনীর ওটা একটা কৌশল মাত্র। কিন্তু ভাবছি, সিরিঞ্জটাও কিভাল কথা, তুই অশোকবারুকে সিরিঞ্জটা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলি?
না।
ভালই করেছিস। জিজ্ঞাসা করবার ওর মধ্যে বিশেষ কিছুই নেই। জিজ্ঞাসা করলে নিশ্চয়ই সে বলত সিরিঞ্জ সম্পর্কে কিছুই জানে না।
কিন্তু সিরিঞ্জের গায়ের আঙুলের ছাপ?
একমাত্র খুনী ছাড়া তিনজন লোকের পাওয়া যেতে পারে—
মানে?
মানে আমার, তোমার ও অশোকের…
এমন সময় ঐ বাড়ির ভৃত্য রামচরণ ঘরে এসে ঢুকল।
সকলেই রামচরণের মুখের দিকে তাকাল একসঙ্গে।
কিরীটী একটিবার মাত্র তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে রামচরণের মুখের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ বুজে চেয়ারটার নড়েচড়ে আরাম করে বসল।
সুব্রতই প্রশ্ন করলে, তোমারই নাম রামচরণ?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
রামচরণের বয়স পঞ্চাশের ঊর্ধ্বেই হবে। রোগা লম্বাটে, ঢ্যাঙা চেহারা! মাথার চুলগুলি সাদায়কালোয় মিশানো। চক্ষু দুটি কোটরপ্রবিষ্ট, কিন্তু দৃষ্টি তীক্ষ্ণ ও সজাগ। চোয়ালের দুই পাশের হাড় বিশ্রীভাবে ঠেলে সজাগ হয়ে উঠেছে। লম্বা লম্বা হাড় বের করা আঙুল। হাতের শিরাগুলিও সজাগ।
পরিধানে পরিষ্কার একখানা ধুতি। গায়ে হাতকাটা একটা সাদা পিরান। কাঁধে একটি পরিষ্কার তোয়ালে! পায়ে একজোড়া চটি।