“স্বচ্ছন্দে।”
“এই ওয়াটারফ্রন্ট জিনিসটা কী?”
প্রশ্ন শুনে কৌশিক হোহো করে হাসতে শুরু করেছিল। ভাদুড়িমশাই তার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা ধমক দিলেন। “বাঁদরামো করিস না।” তারপর মুখ ফিরিয়ে সদানন্দবাবুকে বললেন, “সমুদ্র, নদী কিংবা হ্রদের ধার। ওই মানে যেখানে যেটা পাওয়া যায় আর কি। তো সেটাকেই অতি সুন্দর করে ওরা সাজিয়ে তোলে।”
আমি বললুম, “কত সুন্দর করে, পণ্ডিচেরির সমুদ্রের ধারটা দেখলেই সেটা বোঝ যায়। বিকেলে গিয়ে বেড়াবার পক্ষে একেবারে আদর্শ জায়গা।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “চন্দননগরে গঙ্গার ধারে স্ট্যান্ডটাই কি কিছু কম সুন্দর? এখন অবশ্য একটা মন্দির বানিয়ে গঙ্গার ভিউটাকে এক জায়গায় একটু আটকে দিয়েছে। ওটা ওখানে না বানালেই পারত।”
“কই,” সদানন্দবাবু বললেন, “চন্নননগরে তো এককালে প্রায়ই যেতুম, বিশেষ করে সেখেনকার জগদ্ধাত্রী পুজোর সময়, কিন্তু স্ট্র্যান্ডে অমন মন্দির তো একবারও আমি দেকিনি।”
সদানন্দবাবুর কথা শুনে এতক্ষণ আমার মনে হচ্ছিল যে, চন্দননগর সম্পর্কে তিনি একজন অথরিটি, ওটা তাবই জায়গা, ওখানকাব যাবতীয় ব্যাপার তার নখদর্পণে। কিন্তু তার এই শেষ কথাটা শুনে মনে হল, দীর্ঘকাল তিনি ওদিকে যাননি। মনে হবার কারণ আর কিছুই নয়, বছর তিনেক আগে আমাকে একবার চন্দননগরে যেতে হয়েছিল, স্ট্র্যান্ডের মন্দিরটি তখন আমারও চোখে পড়েছে। অথচ সদানন্দবাবু ওটা দেখতেই পাননি?
ব্যাপারটা ভাদুড়িমশাইও ধরতে পেরেছিলেন। বললেন, “এককালে ওখানে প্রায়ই যেতেন বলছেন। তা এককাল মানে কতকাল আগে?”
সদানন্দবাবু একটুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, “অত তো হলপ করে বলতে পারব না, মশাই, সন-তারিখ সব ঠিকঠাক মনেও নেই। তবে লাস্ট কবে গেসলুম, সেটা বলতে পারি।”
“কবে?”
“সেই যে কলকাতায় জাপানি বোমা পড়ল, সেই বার। হাতিবাগান বাজারে বোমা পড়েছেল না?”
“ওরেব্বাবা, ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “সে তো আর্লি ফর্টিজের ঘটনা। চন্দননগরে তখন পুরোদর ফরাসি শাসন চলছে। সে কি আজকের ব্যাপার?”
“তাতে কী হল?”
“কী আর হবে, স্ট্র্যান্ডের এই মন্দির তখন হয়ইনি। তা হলে আর আপনি দেখবেন কী করে?”
আমি বললুম, “চন্দননগর স্বাধীন হয়েছে বাদবাকি ইন্ডিয়ার পরে। আমরা স্বাধীন হলুম সাতচল্লিশে, আর এখানকার ফ্রেঞ্চ কলোনিগুলি স্বাধীন হল ফিফটিতে। স্বাধীন হল মানে ডি ফ্যাকটো ট্রান্সফার অব পাওয়ার হয়ে গেল। ফ্রান্সের ন্যাশনাল অ্যাসেমব্লিতে সেটা পাস হতে অবিশ্যি আরও দু’দুটো বছর লেগে গেল। যা-ই হোক, এই মন্দির তারও অনেক পরের ঘটনা। গঙ্গার ভিউটা আটকে না দিয়ে ওটা অন্য কোথাও করলেই ভাল হত।
সদানন্দবাবু বললেন, “ফরাসিরা থাকলে ওটা এখেনে হতে পারত না বলচেন তো? ঠিক আছে, সেটা আমি মেনে নিচ্ছি। তবে কিনা গঙ্গার পাড়টা সুন্দর করে বাঁদিয়ে দিয়েছে বলেই যে সব ব্যাপারে তারা সায়েবদের চেয়ে ভাল ছিল, তা কিন্তু ভাববেন না।”
অরুণ সান্যাল বললেন, “সাহেবদের চেয়ে মানে? ফরাসিরা সাহেব নয়?”
“আহাহা, সদানন্দবাবু বললেন, “তা বলছি না, তা বলছি না, আসলে…ওই মানে….” বলে আর কথাটা শেষ করলেন না।
কৌশিক বলল, “বুঝেছি। বোস-জেঠু আসলে বলতে চান যে, ফরাসিরাও সাহেব বটে, তবে বোস-জেই যেখানে চাকরি করতেন, সেই জেনিস অ্যান্ড জেস্কিন কোম্পানির বড়সাহেবের মতো কুলীন-সাহেব নয়।”
“বটেই তো৷” সদানন্দবাবু একটু মিইয়ে গিয়েছিলেন, এবারে ফের তেড়ে উঠে বললেন, “ব্যাটারা ব্যাং খায়।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “শুধু ব্যাং কেন, খরগোশও খায়।”
“আহাহা, খরগোশের কতা হচ্ছে না। খাক না, যত খুশি খরগোশ খা। কিন্তু তাই বলে ব্যাং ও কি একটা খাবাব মতো জিনিস হল?”
“নয় কেন?” ভাদুড়িমশাই বললেন, “ফ্রান্সে থাকতে আমি প্রচুর ব্যাং খেয়েছি। খেতে যে খুব খারাপ, তাও বলতে পারছি না। কী বলব, ব্যাঙের ঠ্যাং অনেকটা মুরগির ঠ্যাঙের মতোই। তবে কিনা আরও সফ্ট।”
সদানন্দবাবু ফুঁসে উঠে বললেন, “আপনি খেতে পারেন, তবে ইংরেজরা খাবে না। কভি নেহি। খিদেয় মরে গেলেও খাবে না।”
ভাদুড়িমশাই হেসে বললো, “এই সেঞ্চৱিব গোড়ার দিকেও খাস লন্ডনের গলিতে গলিতে কী বিক্রি হত জানেন “
“কী বিককিরি হত?”
“আমাদের এখানে ফিরিওয়ালারা যেমন দুপুরের দিকে ঝাঁকা মাথায় গলিতে গলিতে হেঁকে বেড়ায় ‘ভেটকি মাছের কাটা চাই,’ ওখানে তেমনি ফিরিওয়ালারা হেঁকে বেড়াত ‘ক্যাট মিট’। হ্যাঁ, বেড়ালের মাংস।”
শুনে চোখ গোল হয়ে গেল অকণ সান্যালেরও। অবিশ্বাসের গলায় বললেন, “সত্যি?”
“ষোলো আনার উপরে আবও দু’আনা চড়িয়ে বলছি, আঠারো আনা সত্যি।“ ভাদুড়িমশাই বললেন, “ব্রিগস সাহেবের নাম শুনেছ?”
কৌশিক বলল, “তিনি আবার কে?”
“এস ব্রিগস। ইতিহাসের অধ্যাপক। অক্সফোর্ডে পড়াতেন। কথাটা তিনিই বলেছেন।”
“রামশ্চন্দ্র!” সদানন্দবাবু নাক কুঁচকে বললেন, “ইংরেজরা বেড়ালের মাংস খেত?”
ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “আপনাদের কোম্পানির বড়সাহেব মিঃ জেঙ্কিনসের মতো পয়সাওয়ালা ইংরেজরা কেন খেতে যাবে। না না, তারা খেত না। তবে গরিব ইংরেজরা খেত।…আরে মশাই, না খেয়ে যাবে কোথায়? শীতের দেশ, শরীর গরম রাখার জন্যে মাংস তো খেতেই হবে, তা গোরু-ভেড়ার মাংস খাবার মতো রেস্তো যখন নেই, তখন বেড়াল না খেয়ে উপায় কী?”