“ও কতা কইবেন না, ওকতা কইবেন না,” সদানন্দবাবু বললেন, “খাওয়ার কতাই যদি বলেন, তো আমি বলব, খাওয়ার জিনিস চন্নননগরেও কিছু কম নেই। সুজ্যি ময়রার জলভরা তালশাঁসের নাম শুনেছেন?”
অরুণ সান্যাল বললেন, “সেটা আবার কী বস্তু?”
“সন্দেশ। বাইরে ছানা, ভেতরে পিওর নলেন গুড়। অবিশ্যি এখন চত্তির মাস, নলেন গুড়ের টাইম নয়, তাই গুড়ের বদলে ক্ষীর দেবে। পাতলা ক্ষীর।”
“খেতে খুব ভাল?”
শুনে এমনভাবে সদানন্দবাবু অরুণ সান্যালের দিকে তাকালেন যে, তাতেই বোঝ গেল, এর চেয়ে হাস্যকর প্রশ্ন তিনি জীবনে কখনও শোনেননি। বললেন, “ভাল কী বলচেন মশাই, সে তো দেবভোগ্য জিনিস। একবার যদি খেয়েচেন তো বাদবাকি জীবন তার সোয়াদ আপনার মুকে লেগে থাকবে।”
“ওরেব্বাপ রে, কৌশিক হেসে বলল, “চন্দননগর বলতে আমাদের তো একদিকে যেমন দুপ্লের নাম মনে পড়ে, অন্যদিকে তেমনি মনে পড়ে বীর বিপ্লবী কানাইলাল দত্তের কথা। আপনি সেখানে মিষ্টির খবরও রাখেন দেখছি। এতসব ডিটেলস জানার সময় পান কোথায়?”
যেমনভাবে অরুণ সান্যালের দিকে তাকিয়েছিলেন, আস্তে আস্তে মুখ ঘুরিয়ে ঠিক তেমনিভাবেই এবারে কৌশিকের দিকে তাকালেন সদানন্দবাবু। তারপব বললেন, “ওহে ছোকরা, আমাকে দুপ্লে দেকিয়ো না। এই শ্যালদায় থাকি বটে, কিন্তু আসলে আমি কোতাকার লোক?”
ঘাবড়ে গিয়ে কৌশিক বলল, “কেন, তারকেশ্বরের।”
“অ্যান্ড হোয়্যার ইজ তারকেশ্বর?”
এইভাবে যে তার ভূগোল জ্ঞানের পরীক্ষা নেওয়া হবে, কৌশিক তা ভাবতে পারেনি। একটু থতমত খেয়ে মাথা চুলকে বলল, “হুগলি জেলায়। ভুল বললুম?”
“না না, ভুল বলবে কেন, সদানন্দবাবু বললেন, “কারেক্ট আনসার দিযেচ। দশে দশ। তবে কিনা, তারকেশ্বর জায়গাটা হুগলি জেলার মদ্যে হলেও উইদিন দি জুরিসডিকশন অব দি সাবডিভিশন অব চন্নননগর। আর সেদিক থেকে দেকতে গেলে আমি তো চন্নননগরেরই বাসিন্দে হে।”
অরুণ সান্যাল বললেন, “তা তো বটেই।”
সদানন্দবাবু বললেন, “তবেই বুজুন। তা আমি যদি না সেখেনকার হাডিৰ খপর রাকি, তো কে রাকবে। চনননগরের মিষ্টি তো ভালই, সেখেনকার গঙ্গাব তোপসে আর ইলিশও অতি চমৎকার।..আর হ্যাঁ, চাপাকলা থেকে যে ওয়াইন এখেনে সেব করে, তা তো কোনও তুলনাই হয় না।
ভাদুড়িমশাই বললেন, “খেয়ে দেখেছেন?”
“রামশ্চন্দ্র!” জিব কেটে সদানন্দবাবু বললেন, “বাপ-ঠাকুদ্দা খেতেন, তেনাদের কাছে নিচি। শুনে লোভ হয়েছিল বলে একবার এক বোতল ওই ওয়াইন জোগাড় করে বাড়িতে যে নিয়ে আসিনি, তাও নয়। কিন্তু আমার ওয়াইফকে তো চেনেন, রেশনের ব্যা; থেকে বোতলটা বার করতেই তিনি এমন হল্লা জুড়ে দিলেন যে, সে আর কহতব্য নয়।…না না, পয়সাটা স্রেফ জলে গেল, পয়সা দিয়ে যা কিনে আনলুম, তা আর আমার খাওয়া হয়নি।”
“বোতলটা কী হল? মিসেস বোস সেটা আছড়ে ভাঙলেন?”
“তা হলেও তো বুজতুম।” সদানন্দবাবু কাতর গলায় বললেন, “কিন্তু তাই-ই বা তিনি ভাঙলেন কোতায়। পরের দিন তার ছোট ভাই আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এয়েছিল। দিদির বাড়িতে এক থালা সন্দেশ রসগোলা সাঁটিয়ে যখন বিদেয় নিচ্ছে, তখন বোতলটা তার হাতে তুলে দিয়ে বললে, এটা নিয়ে যা, তোর জামাইবাবু তোরই জন্যে নিয়ে এয়েচে, খুব পষ্টিকর জিনিস।…একচোকোমি আর কাকে বলে।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “ও নিয়ে আব দুঃখ করবেন না বোসমশাই, আমার সঙ্গে চন্দননগরে যাচ্ছেন তো?”
“তা তো যেতেই হবে, তা নইলে ওখানকার রাস্তাঘাট আপনি চিনবেন কী করে? ও তো বলতে গেলে আমারই জায়গা।”
“ঠিক আছে, ওই চাপালার ওয়াইন তা হলে ওখানেই আপনাকে খাইয়ে দেবখন।” ভাদুড়িমশাই হাসতে হাসতে বললেন, “আমি অবশ্য ওই জন্যে চন্দননগরের কেসটা হাতে ‘নিইনি। সন্দেশ কিংবা তোপসে আর ইলিশের জন্যেও না।”
“তা হলে?”
“ওখানে আমার এক বন্ধু আছেন, অনেক দিনের পুরনো বন্ধু, কিন্তু অনেক কাল দেখা হয় না। বিমলভূষণের কাজটা নিতে যে এক কথায় রাজি হয়ে গেলুম, সেটা আসলে এই বন্ধুটির টানে।”
জিজ্ঞেস করলুম, “চন্দননগরে কি ওই বন্ধুর বাড়িতেই উঠবেন আপনি?”
“একা আমি কেন, আমরা তিনজনেই উঠব।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “তবে কোথায় উঠব, সেটা এখন বলা যাচ্ছে না। আগে তো চন্দননগরে যাই, বিমলভূষণের সঙ্গে কথা বলি, তারপর যদি দেখি যে, কাজের সুবিধের জন্যে শিবমন্দিরের কাছাকাছি থাকা দরকার, তো তাই বুঝে বিমলভূষণ যেখানে ব্যবস্থা করেন, সেখানেই থাকা যাবে।”
এক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। একটা সিগারেট ধরালেন। তারপর দেশলাইয়ের জ্বলন্ত কাঠিটাকে শূন্যে বার দুই-তিন ঝাঁকি মেরে, নিবিয়ে, অ্যাশট্রেতে ফেলে দিয়ে বললেন, “পরমেশের…আই মিন আমার এই চন্দননগরের বন্ধুটির..বাড়িটি ভারি সুন্দর। স্ট্যান্ডের খুব কাছেও বটে।…ওরে কৌশিক, তুই কখনও চন্দননগরে গেছিস?”
কৌশিক মাথা নাড়ল। “না, মামাবাবু।”
“পণ্ডিচেরিতে?”
এবারেও কৌশিককে দু’দিকে মাথা নাড়তে দেখে ভাদুড়িমশাই বললেন, “তাও না? তবে আর তুই জানবি কী করে যে, ওয়াটারফ্রন্টকে ফরাসিরা কত সুন্দরভাবে কাজে লাগায়। অন্তত এই একটা ব্যাপারে আমি তো ওদের কোনও তুলনাই খুঁজে পাই না।”
সদানন্দবাবু উশখুশ করতে শুরু করেছিলেন। গলা খাকরে বললেন, “একটা কতা জিগেস করব?”