“আজ্ঞে হ্যাঁ।” বিমলভূষণ বললেন, “আমার প্রপিতামহের তিনিই একমাত্র সন্তান। তার পরে আর আমার প্রপিতামহ কালীভূষণের অন্য কোনও পুত্রকন্যা হয়নি।”
“কালীভূষণও তো তার বাবার একমাত্র সন্তান?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ।”
“কীর্তিভূষণকে তা হলে পাঁচ বছর বয়েস থেকে বড় করে তুললেন কে? আর ওই সম্পত্তি? মানে কালীভূষণের সম্পত্তিও তো নেহাত কম ছিল না। সে-সবের দেখাশুনোই
বা কে করতেন?”
“সবই করতেন আমার প্রপিতামহী, অর্থাৎ শান্তিলতা দেবী।” বিমলভূষণ বললেন, “অবিশ্যি নায়েব-গোমস্তারা ছিল না, তা নয়। দূর-সম্পর্কের কিছু পোষ্যও ছিল। কিন্তু আমার প্রপিতামহীর অনুমতি ছাড়া কারও কিছু করার সাধ্য ছিল না। তা সে অনুমতিই বলুন আর হুকুমই বলুন। ছেলেবেলায় আমার ঠাকুর্দার কাছে অন্তত সেইরকমই শুনেছি।”
“তার মানে তিনি খুবই কড়া ধাতের মহিলা ছিলেন, কেমন?”
“আজ্ঞে তা বলতে পারেন।”
সদানন্দবাবু বললেন, “ওই যাকে ছুঁদে মেয়েছেলে বলে আর কী।”
ভাদুড়িমশাই এতক্ষণ পর্যন্ত মাথা নিচু করে চুপচাপ সব শুনে যাচ্ছিলেন। একটাও কথা বলেননি। সদানন্দবাবুর মন্তব্য শুনে তিনি চকিতে একবার মুখ তুলে তার দিকে তাকালেন। যে-রকম ভুরু কুঁচকে তাকালেন, তাতে বুঝলুম, মন্তব্যটা তার পছন্দ হয়নি। ‘মেয়েছেলে’ শব্দটা তার কানে নিশ্চয় আপত্তিকর ঠেকে থাকবে।
তবে, যার প্রপিতামহী সম্পর্কে এই অশিষ্ট শব্দ প্রয়োগ, তার কোনও ভাবান্তর দেখলুম না। বরং সদানন্দবাবুর দিকে তাকিয়ে সমর্থনসূচক ভঙ্গিতে উপর-নীচে একবার শির-সঞ্চালন করে তিনি বললেন, “একেবারে খাঁটি কথাটাই বলেছেন। আমার ঠাকুমা অবিশ্যি তার শাশুড়ির কথা উঠলে উঁদে না বলে বলতেন জাহাবাজ মেয়েছেলে। তারই কাছে শুনেছি যে, আমার ঠাকুর্দার লাইফকে তিনি একেবারে হেল করে ছেড়ে দিয়েছিলেন!”
“কী-রকম, কীরকম?” উৎসাহিত হয়ে সদানন্দবাবু তার শরীরটাকে একটু এগিয়ে এনেছিলেন। সেই অবস্থায় মাথা ঝুঁকিয়ে বললেন, “মায়ের পারমিশান না নিয়ে আপনার ঠাকুর্দার কিছু করার উপায় ছিল না বুঝি?”
“কিছু না।” বিমলভূষণ বললেন, “উঠতেও পারমিশান চাই, বসতেও পারমিশান চাই। মায়ের পারমিশান পাননি বলে নাকি জীবনে কখনও শ্বশুরবাড়িই যাওয়া হয়নি আমার ঠাকুর্দার। ঠাকুমার কাছে শুনেছি, তারও বাপের বাড়ি যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন।”
“অ্যাঁ?” সদানন্দবাবু ডুকরে উঠে বললেন, “বাপের বাড়ি যাওয়া বন্ধ?”
“বিলকুল। এ কি ভাবা যায়?”
“না, ভাবা যায় না।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিন্তু ও-সব বাদ দিয়ে এবারে কাজের কথায় আসুন। আপনার সমস্যা তো দুটো হিরে নিয়ে। তাব কী হল? ও দুটো কি চুরি হয়ে গেছে?”
প্রসঙ্গ একেবারে হঠাৎই পালটে যাওয়ায় বিমলভূষণ সম্ভবত ফের একটু বিভ্রান্ত বোধ করছিলেন, সেটা কাটিয়ে উঠে বললেন, “ও হ্যাঁ, হিরে। না, চুবি হয়ে যায়নি। কিন্তু হবে।”
“জানলেন কী করে?”
“আমাদের পুজুরি ঠাকুর বলছিলেন, গঙ্গার ঘাটে দু’জন লোককে তিনি এই নিয়ে বলাবলি করতে শুনেছেন।
“এটা কবেকার কথা?”
“মাসখানেক আগের। তার হপ্তা দুয়েক বাদেই আমি বাঙ্গালোরে ফোন করি।”
শুনে একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই, তারপর বললেন, “হরপার্বতীর মূর্তিতে কি সারা বছরই হিরে দুটো পরানো থাকে?”
“আজ্ঞে না,” বিমলভূষণ বললেন, “পরানো হয় শুধু চৈত্রসংক্রান্তির দিনে।”
“কিন্তু তার তো আর দেরি নেই।”
“আজ্ঞে না। আজ এগারোই এপ্রিল, চোদ্দো তারিখে সংক্রান্তি। মাঝখানে আর মাত্তর দুটো দিন। হিরে দুটো সিন্দুকে ভোলা আছে। চোদ্দো তারিখের সূর্যোদয়ের আগেই সিন্দুক থেকে বার করে হরপার্বতাঁকে পরিয়ে দেব।”
শুনে, আবার একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই, তারপরে বললেন, “আপনি চন্দননগরে ফিরছেন কবে?”
“আজই ফিরে যাব।”
“ভাল। আমি কাল সকালে যাচ্ছি। আপনি ঠিকানাটা লিখে দিয়ে যান।”
বিমলভূষণ একটা ছাপানো কার্ড বার করে ভাদুড়িমশাইয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “ঠিকানা এতেই আছে। তবে কিনা দরকার হবে না। চন্নননগরে গিয়ে যে কাউকে আমার নাম বললেই রাস্তা দেখিয়ে দেবে।”
ভাদুড়িমশাইয়ের হাত থেকে নিজের ছড়িখানা ফেরত নিয়ে, নমস্কার করে ভদ্রলোক বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। পেছন থেকে ভাদুড়িমশাই বললেন, “ও হ্যাঁ, একটা কথা ছিল।”
ঘুরে দাঁড়িয়ে ভদ্রলোক বললেন, “বলুন।”
“আপনি কলপ দেওয়া বন্ধ করলেন কেন?”
এতক্ষণে হাসলেন বিমলভূষণ। বললেন, “চামড়ায় একটা র্যাশ বেরোচ্ছিল। ডাক্তারের অ্যাডভাইসে বন্ধ করেছি।”
.
॥ ৩ ॥
বিমলভূষণকে লিফট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গিয়েছিল কৌশিক। ফিরে এসে বলল, “বাবা রে বাবা! সোনা নয়, এপো নয়, হিরে! তাও আবার একটা নয়, একজোড়া! দাম কত হবে, মামাবাবু?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা কী করে বলব? কত ক্যারাট, তা-ই তো জানি না। তবে হ্যাঁ, যদি ইন্ডাস্ট্রিয়াল হিরে হয়তো খুববেশি দাম না-হওয়াই সম্ভব।“
আমি বললুম, “আপনি তা হলে কালই ওখানে যাচ্ছেন?”
“যাওয়াই উচিত।” অরুণ সান্যাল বললেন, “গাড়িতে করে গেলে চন্দননগরে পৌঁছতে কতক্ষণই বা লাগবে।”
কৌশিক বলল, “মেরেকেটে ঘণ্টা দেড়েক। অবিশ্যি যদি জি.টি. রোডে জ্যাম না থাকে। যা মামাবাবু, ঘুরেই এসো।
ভাদুড়িমশাই বললেন, “আর তুই এখানে বসে ছুটি কাটাবি আর মায়ের রান্না করা ভালমন্দ খাবি, কেমন?”