“পোড়াবাজারের ওই ছেলে দুটোর কথা ভেবে এ-কথা বলছে তো?”
“এগজ্যাকটলি। পরও ওরা অত ভাল খেলেছিল। আজও ফাসঁ হাফে দাপিয়ে খেলেছে। অথচ তার পরেই কেমন যেন চুপসে গেল। কোনও মানে হয়?”
বললুম, “ভাদুড়িমশাই তো বললেন, ফার্স্ট হাফে অত দাপিয়ে খেলার জন্যেই সেকেণ্ড হাফে হাসে গেসল। তখন আর দম পায়নি।”
সদানন্দবাবু বললেন, “সে তো উনি ওঁর বক্তৃতাতেও বলেছেন, আবার একটু আগে বারান্দায় বসেও বললেন। কিন্তু আপনাকে ওই কতাটা যখন বলেন, তখন ওঁয়ার মুকটা দেখেছিলেন?”
“না তো।”
“দেকলে বুজতেন যে, ওটা ওঁয়ার মনের কতা নয়।”
“এটা কী করে বুঝলেন?”
“মুক দেকে বুজলুম।” সদানন্দবাবু বললেন, “উনি তখন মুক টিপে হাসছিলেন।”
অস্বস্তি তো একটা ছিলই, সদানন্দবাবুর কথা শুনে সেটা আরও বেড়ে যায়। তবে কাল রাত্তিরে এ নিয়ে আর কথা হয়নি। দিনটা ঘোর উত্তেজনার মধ্যে কেটেছে, খেলা শেষ হওয়ার পর আর-সকলের সঙ্গে গলা মিলিয়ে আমিও নেহাত কম চেঁচাইনি, হয়তো সেই জন্যেই একটু ক্লান্ত ছিলুম, খানিক বাদেই তাই ঘুমিয়ে পড়ি।
কিন্তু মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি থেকে গেলে যা হয় আর কি, ঘুমটা বিশেষ সুবিধের হল না।
আজ খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেছি। স্রেফ চা-বিস্কুট খেয়ে কাটায় কাটায় ছটায় আমরা দত্তবাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ি। শক্তিগড়ে আসার পথে কলকাতা থেকে মগরা পর্যন্ত আমি গাড়ি চালিয়ে এসেছিলুম, সেখান থেকে শক্তিগড় পর্যন্ত স্টিয়ারিং হুইলে ছিলেন ভাদুড়িমশাই। ফিরতি পথে আমি যে মগর পর্যন্ত গাড়ি চালাব, আর সেখান থেকে কলকাতা পর্যন্ত ভাদুড়িমশাই, এটা আগে থাকতেই ঠিক করা ছিল। সেই অনুযায়ী মগরা পৌঁছে রাস্তার ধারের একটা চায়ের দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ভাদুড়িমশাইকে বলি, “নিন, আপনি এবারে স্টিয়ারিং হুইলে এসে বসুন।”
ভাদুড়িমশাই তাতে হেসে বলেন, “তা বসছি। কিন্তু তার আগে একবার চা খেয়ে নিলে হত না?”
বললুম, “বিলক্ষণ।”
চায়ের দোকানের সামনেই গাড়ি দাঁড় করিয়েছি, জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ভাদুড়িমশাই দোকানিকে বললেন, “তিনটে চা দিন তো। দুধ আর চিনি কম দেবেন, চা বেশ কড়া হওয়া চাই।” বলে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনার ধাঁধা কেটেছে?”
হেসে বললুম, “না।”
“ঠিক আছে, সেটা কাটিয়ে দিচ্ছি।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “নইলে মগরার বিখ্যাত চা খেয়েও আপনার শাস্তি হবে না। আরে মশাই, কালকের খেলায় প্রথম হাফে অত লম্ফঝম্প করার পরে পোড়াবাজার যে সেকেন্ড হাফের শেষের দিকে একেবারে ঝিমিয়ে গিয়েছিল, সেটাই তো স্বাভাবিক।”
সদানন্দবাবু বললেন, “এ-কতা কেন বলচেন সেমিফাইনালের দিনেও তো ওদের খেলা আমরা দেকিচি। সেদিন কিন্তু দুটো হাফেই ওরা সমান দাপটে খেলেছিল।”
আমি বললুম, “কালকের খেলাকে সেইজন্যেই আমাদের অস্বাভাবিক লেগেছে।”
“আরে মশাই,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপনাদেব মুশকিল কী হয়েছে জানেন? যা স্বাভাবিক, তাকে আপনারা অস্বাভাবিক ভাবছেন, আর অস্বাভাবিকটাকেই ভাবছেন স্বাভাবিক।”
“তার মানে?”
“তার মানে সেমিফাইনালের দিন ওরা যা খেলেছে, সেটা মোটেই স্বাভাবিক খেলা নয়। শুরু থেকে শেষ অব্দি পুরো নব্বইটা মিনিট কেউ ওই রকমেরর সমান দাপটে খেলতে পারে না। বিশেষ করে চোত মাসের চাদি-ফাটা রোদ্দুরে। না না, ওটা সম্ভব নয়।”
“তা হলে ওরা পারল কী করে?”
“সেটাই হচ্ছে কথা।” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “সেদিন যে ওরা পেরেছিল, নিশ্চয় তার একটা কারণ ছিল। আবার কাল যে ওরা পারেনি, তারও নিশ্চয় একটা কারণ আছে।”
বললুম, “হেঁয়ালি হয়ে যাচ্ছে, বড় হেঁয়ালি হয়ে যাচ্ছে ভাদুড়িমশাই। কারণটা কী, সেটা খুলে বলুন তো! ঘুষ?”
“যাচ্চলে, কে কাকে ঘুষ দেবে? আর দেবেই বা কেন?”
“বাঃ, কে ঘুষ দেবে, আর কেন দেবে, সেটা বোঝা কি খুব কঠিন নাকি?” আমি বললুম, “কৃপানাথ তো বলেইছিলেন যে, অন্তত একবার ওঁরা শিল্ডটা পেতে চান। বলেননি?”
“হ্যাঁ, তা তো সে বলেইছিল,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “তাতে দোষের কী আছে?”
“চাওয়ার মধ্যে দোষের কিছু নেই।” তেতো গলায় আমি বললুম, “কিন্তু যা চাইছি, ঘুষ দিয়ে পাওয়ার মধ্যে আছে।”
ভাদুড়িমশাই হোহো করে হেসে উঠে বললেন, “কৃপানাথকে আপনি চেনেন না। চিনলে অমন কথা বলতেন না। যা-ই হোক, কারণটা ঘুষ নয়।”
“কারণটা তা হলে কী?”
তক্ষুনি এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সরু চোখে ভাদুড়িমশাই আমার দিকে তাকিয়ে, রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর তার পাঞ্জাবির ঝুল-পকেট থেকে একটা কাঁচের শিশি বার করে আমাদের সামনে সেটা তুলে ধরে বললেন, “এই হচ্ছে কারণ। এর মধ্যে ছোট-ছোট কিছু ট্যাবলেট আছে। সেমিফাইনালের দিন হাফটাইমের সময় পোড়াবাজারের ছেলেদের প্রত্যেককে এই ট্যাবলেট খাওয়ানো হয়েছিল বলেই সেকেন্ড হাফেও তাদের তেজ আর দাপট কিছু কমেনি, আর ফাইনালের দিন হাফ-টাইমের সময় এটা খায়নি বলেই সেকেন্ড হাফে তারা ঝিমিয়ে যায়।
শুনে আমি স্তম্ভিত। বললুম, “এ তো ড্রাগ!”
ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “মারাত্মক ড্রাগ! আপনাকে যদি এই ট্যাবলেট খাইয়ে মাঠে নামিয়ে দেওয়া হয়, তো এই বয়সেও আপনি বোধহয় মিলখা সিংয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়তে চাইবেন।”
সদানন্দবাবুর চোখ দুটো প্রায় কপালে উঠে গিয়েছিল। বাকশক্তিও লোপ পেয়ে থাকবে। সেটা ফিরে পাবার পরে বললেন, “এই শিশিটা আপনি পেলেন কোতায়?”