কৃপানাথের পরের ভাই শম্ভুনাথের উপরেই যেহেতু অতিথি-আপ্যায়ন ও ল্যাংচা বিতরণের দায়িত্ব ছিল, তাই এতক্ষণ তিনি দম ফেলবার ফুরসত পাচ্ছিলেন না। হই-হল্লা থেমে যাবার পরে রাত দশটা নাগাদ তিনি আমাদের কাছে এসে বললেন, “আপনারা তো কাল ভোরেই রওনা হচ্ছেন, তা হলে আর দেরি করা ঠিক হবে না, রাত্তিরের খাওয়া চুকিয়ে এবারে শুয়ে পড়াই ভাল।”
শুতে শুতে কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই বারোটাই বাজল। তার আগে কালকের মতো আজও দোতলার বারান্দায় এসে বসেছি। হঠাৎ ভাদুড়িমশাই বললেন, “কী ব্যাপার বলুন তো কিরণবাবু, মনে হচ্ছে যেন কিছু একটা ব্যাপার নিয়ে আপনি খুব চিন্তায় পড়ে গেছেন।”
হেসে বললুম, “না না, তেমন কিছু না, তবে কিনা একটা ব্যাপার নিয়ে যে একটু ভাবছি, সেটা ঠিক। তাই নিয়ে একটু অস্বস্তিও হচ্ছে।”
“কী নিয়ে ভাবছেন?”
“আপনারই একটা কথা নিয়ে। মাঠে আপনার বক্তৃতায় আপনি বললেন যে, পোড়াবাজার টিমের তাবৎ শক্তি খেলার ফাস্ট হাফেই শেষ হয়ে গিয়েছিল, তাই শেষ দিকে আর তারা কিছু করে উঠতে পারেনি। কিন্তু সত্যিই কি তা-ই?”
তা ছাড়া আর কী,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “সেকেন্ড হাফের শেষ দিকে তো সেই জন্যেই ওরা শক্তিগড়ের ফরোয়ার্ড লাইনকে আটকাতে পারল না। ভীষণ হাপসে গেল যে!”
বললুম, “তা-ই যদি হবে তত সেমিফাইনালের দিনে দুই হাফেই পোড়াবাজার অত ভাল খেলল কী করে? নব্বই মিনিটের খেলা, তার প্রথম থেকে শেষ মিনিট পর্যন্ত ওরা একইরকম স্পিডে, একইরকম দাপটের সঙ্গে সেদিন খেলেছে। বিশেষ করে ওই মানিকজোড়। কই, ফাস্ট হাফে যে ওয়র্ক-লোড ওরা নিয়েছিল, তার জন্যে তো সেদিন সেকেন্ড হাফে ওরা একটুও হাপসে যায়নি। আজ তা হলে এমন হল কেন?”
ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “আহা, বাইচং আর চিমাও কি রোজই ভাল খেলে নাকি। মাঝে-মাঝে কি ওরাও ঝিমিয়ে যায় না? ধরে নিন, পোড়াবাজারের ওই মানিকজোড়ও আজ ঠিক ফর্মে ছিল না, ফাস্ট হাফে ভাল খেললেও সেকেন্ড হাফে ঝিমিয়ে গিয়েছিল।
শুনে চুপ করে গেলুম বটে, কিন্তু ব্যাখ্যাটা খুব জুতসই বলে মনে হল না, অস্বস্তির একটা কাটা কোথাও বিধেই রইল। ভাদুড়িমশাইকে সে-কথা বললুমও। হেসে বললুম, “যা-ই বলুন মশাই, ধাঁধাটা কিন্তু কাটল না।”
.
॥ ৫॥
আজ ১৪ এপ্রিল সোমবার। ভোর ছ’টায় শক্তিগড় থেকে রওনা হয়ে সাড়ে আটটায় বালি ব্রিজ পেরিয়ে দক্ষিণেশ্বরে পৌঁছই। ভেবেছিলুম সাড়ে ন’টার মধ্যেই শেয়ালদায় আমাদের বাড়িতে পৌঁছে যাব। সেখানে আমাকে আর সদানন্দবাবুকে নামিয়ে দিয়ে ফ্লাইওভার পেরিয়ে ফের উত্তরমুখো হয়ে আপার সার্কুলার রোড ধরে ভাদুড়িমশাই কাকুরগাছিতে চলে যাবেন। কিন্তু আজ বাংলা নববর্ষ। ইস্কুলের ছেলেমেয়েরা নানান জায়গায় মিছিল বার করেছে। ব্যান্ড পার্টিও বেরিয়েছে এখানে-ওখানে। ফলে ইতস্তত গাড়িঘোড়া আটকে গিয়ে জ্যামও নেহাত কম হচ্ছে না। দক্ষিণেশ্বর থেকে শেয়ালদা পৌঁছতে তাই পাক্কা দু ঘণ্টা লেগে গেল। দুপুরে একটু দেরি করে আপিসে গিয়েছিলাম। ফিরতে ফিরতে রাত ন’টা। তারপর গান করে, রাত্তিরের খাওয়া চুকিয়ে বসার ঘরে এসে একটা সিগারেট ধরিয়ে এখন একটু বিশ্রাম নিচ্ছি। নতুন একটা বই বেরোচ্ছে। পাবলিশার তার প্রুফ দিয়ে গেছে। একটু বাদে সেই পুফ নিয়ে বসব। তার আগে বরং যে ঘটনার কথা এখানে বলতে বসেছি, তার শেযটুকু বলে নিই।
কালকের শিল্ড ফাইনালে পোড়াবাজারের অত খারাপ খেলার যে ব্যাখ্যা ভাদুড়িমশাই দিয়েছিলেন, তা যে আমার মনঃপুত হয়নি, তা তো আগে বলেইছি। এও বলেছি যে, ভাদুড়িমশাই যা-ই বলুন, অস্বস্তির একটা কাটা আমার মনের মধ্যে তার পরেও বড্ড খচখচ করছিল। রাত্তিরে, ঘুমিয়ে পড়ার আগে, সদানন্দবাবুর সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছিল, অস্বস্তি একা আমার নয়, তারও। বিছানায় শুয়ে দু’চার বার এপাশ ও পাশ করে সদানন্দবাবু বললেন, “দেকুন মশাই, একটা কতা বলব?”
বললুম, “বলে ফেলুন।”
“আমরা তো এঁয়াদের গেস্ট, ঠিক কি না?”
“বিলক্ষণ।”
“এঁয়ারা আমাদের খুবই যত্ন-আত্তি করচেন, ঠিক কিনা?”
“সে আর বলতে?”
“পঞ্চব্যঞ্জনের বদলে পঞ্চান্ন ব্যঞ্জন খাওয়াচ্চেন বললেই ঠিক হয়, তাই না?”
“অবশ্য।”
“তার উপরে দেকুন, মুখ ফুটে কিছু বলবার আগেই এয়ারা স্পেশ্যাল অর্ডার দিয়ে তিন হাঁড়ি ল্যাংচা আনিয়ে রেকেচেন। কেন জানেন?”
“কেন?”
“কাল সকালে, আমাদের গাড়িতে তুলে দেবেন।”
“বলেন কী?”
“ঠিকই বলছি।” সদানন্দবাবু বললেন, “এবারে আপনি বেশ ভেবেচিন্তে একটা কতা বলুন তো।”
“কী বলব?”
“যারা আমাদের জন্যে এত করচেন, শিল্ড ফাইনালে এই যে তারা জিতলেন, এতে তো আমাদের খুশি হওয়াই উচিত, তাই না?..না না, তাড়াহুড়ো করতে হবে না, বেশ ভেবেচিন্তে বলুন।”
“এতে এত ভাববার কী আছে,” বললুম, “নিশ্চয় খুশি হওয়া উচিত।”
ঘর অন্ধকার। তবু বুঝলুম, সদানন্দবাবু একটা দীর্ঘ নিশাস মোচন করলেন। বললুম, “কী হল, চুপ করে গেলেন কেন?”
“কী আর বলব বলুন,” খুবই বিভ্রান্ত গলায় সদানন্দবাবু বললেন, “খুশি হওয়াই যে উচিত, তা কি আর আমি জানি না? জানি। কিন্তু হতে পাবচি কোতায়?”
“তার মানে?”
“মানে আর কিচুই নয়, ব্যাপারটা একটু ফিশি লাগছে।” এক সেকেন্ড চুপ কবে থেকে সদানন্দবাবু বললেন, “আপনার লাগছে না?”