ভাদুড়িমশাই বললেন, “সে কী মশাই, এমন হাড্ডাহাড্ডি লড়াই, কে হারে কে জেতে কিছু বোঝা যাচ্ছে না, এ-খেলা শেষ পর্যন্ত না দেখেই উঠে যাবেন?”
“না, মানে শরীরটা একটু খারাপ লাগছে কিনা, তাই ভাবছিলুম..”
“ভাববার কিছু নেই,” আমি বললাম, “নিশ্চিন্ত থাকুন, আগুন জ্বলবে না, ও-সব কথার কথা। আর তা ছাড়া খেলা তো প্রায় শেষ হয়ে এল, আর মাত্র দশ মিনিট।”
শুনে, সদানন্দবাবু কপালে হাত ঠেকিয়ে বিড়বিড় করে বললেন, “দুগা দুগ্ন, এই দশটা মিনিট এখন ভালয়-ভালয় কাটলে বাঁচি।”
আশ্চর্য কাণ্ড, ওই দশ মিনিটের মধ্যেই খেলাটা একেবারে দুম করে বদলে গেল। পোড়াবাজারের সেই মানিকজোড় নিজেদের মধ্যে বল দেওয়া-নেওয়া করতে করতে একটু বেশি রকমের বিপজ্জনকভাবে এসে পড়েছিল একেবারে শক্তিগড়ের বক্সের সামনে। সেখান থেকে তাদের মধ্যে একজন হঠাৎ বাঁ দিকের স্টপারকে কাটিয়ে গোলে শট নেয়। কিন্তু একে তো শক্তিগড়ের গোলকিপার আর ডান দিকের স্টপার ততক্ষণে জায়গামতো পজিশন নিয়ে গোলের মুখটাকে খুবই ছোট করে এনেছে তার উপরে আবার ফরোয়ার্ড লাইনের খেলোয়াড়টির খাটুনির চাপ ইতিমধ্যে বড্ড বেশি হয়ে যাওয়ায় তার শটে তেমন জোরও ছিল না। ভূতনাথ ওদিকে বক্সের কাছাকাছি একটু ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছিল। গড়ানে শটটিকে হাত দিয়ে তুলে নিয়ে গোলকিপার সেটিকে ভূতনাথের দিকে ছুঁড়ে দিতেই বলটিকে ট্র্যাপ করে ভূতনাথ পরক্ষণেই এমনভাবে ছুটতে শুরু করে যে, বুঝতে পারা যায়, এইরকম একটা সুযোগের প্রতীক্ষাতেই ছিল সে। পোড়াবাজারের গোলকিপার আর একজন স্টপার ছাড়া বাকি ন’জন খেলোয়াড়ই তখন শক্তিগড়ের গোলের দিকে উঠে এসেছে, বলতে গেলে বাদবাকি মাঠ একদম ফাঁকা। স্টপারটি তাকে আটকাতে এসেছিল, কিন্তু এক সেকেন্ডের জন্যে থেমে থেকে, হঠাৎই গতি বাড়িয়ে ভূতনাথ একেবারে ছিটকে বেরিয়ে যায় তার পাশ দিয়ে। গোলকিপার বিপদ বুঝে সামনে এগিয়ে এসেছিল ঠিকই, কিন্তু ভূতনাথ আর তাকে কাটাবার চেষ্টা না করে ডান পায়ের একটা ছোট্ট টোকায় বলটাকে তার মাথার উপর দিয়ে লব করে গোলে পাঠিয়ে দেয়।
শক্তিগড়ের বাসিন্দারা তো খেলা শুরু হবার ঘণ্টা খানেক আগে থেকেই দলে দলে মাঠে এসে জমায়েত হয়েছিলেন। সেই জমাটি ভিড়ের ভিতর থেকে পরক্ষণেই যে চিৎকারটা ওঠে, যদি শুনি যে, বর্ধমান শহর থেকেও সেটা শোনা গিয়েছিল তো অবাক হব না। সেটাই অবশ্য শেষ জয়ধ্বনি নয়। খেলা শেষ হতে তখনও আরও মিনিট ছয় সাত বাকি, তারই মধ্যে আরও দু-দুবার জয়ধ্বনি ওঠে। তিনটে গোলই ভূতোবাবুর। তার মধ্যে শেষ গোলটা এল বাইসিল কিক থেকে। আর সেটা আসার সঙ্গে-সঙ্গেই বেজে উঠল রেকারির হুইল। একবার নয়, দু’বার। একটা বাঁশি গোলের, অন্যটা খেলা শেষের।
খেলা শেষ। কিন্তু উত্তেজনা শেষ নয়। শক্তিগড়ের বাসিন্দারা তারস্বরে চেঁচাচ্ছেন, জনা কয়েক খেলোয়াড় ভুতোকে কাঁধে তুলে নিয়ে ঘুরছে, কৃপানাথের চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে, আর পোড়াবাজারের কোচটি তারই মধ্যে চেঁচিয়ে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে, কিন্তু সেটা যে কী, চারপাশের তুমুল হট্টগোলের মধ্যে কথাগুলো চাপা পড়ে যাওয়ায় তা আর কেউ বুঝে উঠতে পারছে না।
সদানন্দবাবুর ভয় কেটে গিয়েছিল। উত্তেজনায় তিনি টগবগ করে ফুটছিলেন। ভূতনাথের খেলা দেখে তিনি এতই মুগ্ধ যে, পুরস্কার বিতরণের সময় তার নামে একটা মেডেল ডিক্লেয়ার করে দিলেন। বললেন, কলকাতায় গিয়ে আমাদের স্যাকরাকে দিয়ে রুপোর মেডেল বানিয়ে তাতে ভুতোবাবুর নাম খোদাই করে সামনের হপ্তার মধ্যেই পাঠিয়ে দেব।
মারা যাবার পরে সবাই যেমন সাধনোচিত ধামে প্রয়াণ করে, পুরস্কার বিতরণী সভাতেও সভাপতিরা তেমন ‘সময়োচিত বক্তৃতা দেন। ভাদুড়িমশাই একটি সময়োচিত বক্তৃতা দিলেন। খেলাধুলোর উপকারিতা সম্পর্কে দু’চার কথা বলার পরে বিশেষ করে আজকের ফাইনাল খেলা সম্পর্কে বললেন, “পোড়াবাজার বেশ শক্তিশালী দল, কিন্তু একই সঙ্গে একটু বেহিসেবি। নয়তো খেলার প্রথমার্ধে নিজেদের শক্তির চোদ্দো আনাই তারা খরচ করে ফেলত না। এই অপচয়ের মাসুলই তাদের দ্বিতীয়ার্ধে দিতে হয়েছে। শক্তিগড় সেক্ষেত্রে প্রথমার্ধে তাদের শক্তি-সামর্থ্যের ভাড়ার অটুট রেখে পোড়াবাজারের আক্রমণগুলিকে ঠেকিয়ে গিয়েছে মাত্র। দ্বিতীয়ার্ধেরও অনেকটা সময় তারা আক্রমণে ওঠেনি। উঠেছে একেবারে শেষ সময়ে, যখন সেই আক্রমণ ঠেকাবার মতো সামর্থ্য আর পোড়াবাজারের ছিল না। খেলার সঙ্গে যুদ্ধের তুলনা টেনে বলা যায়, এও আসলে এক ধরনের ওয়ার অব অ্যাট্রিশন। নিজের পুঁজি যতটা পারা যায় অটুট রেখে শত্রর পুঁজিকে শেষ করে আনা। শক্তিগড়ের এই যে কৌশল, এটাই তাদের সাফল্য এনে দিয়েছে।”
খেলার ফলাফল সম্পর্কে ভাদুড়িমশাইয়ের এই যে ব্যাখ্যা, এটা নিয়ে যে আমার মনে কোনও ধন্ধ ছিল না, তা নয়, কিন্তু তখন আর এ নিয়ে কিছু বললাম না। কথাটা তুললুম ঘণ্টা কয়েক বাদে। রাত্তিরের খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকে যাবার পর।
রেফারির শেষ হুইল বাজার পরে মাঠের মধ্যে যে জয়োল্লাসের সূচনা হয়, তার জের তখনও পুরোপুরি মেটেনি। ভূতনাথের গলায় যে গণ্ডা-দশেক পুষ্পমাল্য পরানো হয়েছে, তাতেই তার একেবারে ঢাকা পড়ে যাবার জোগাড়। সেই অবস্থায় একটা লরির উপরে বসিয়ে ভূতনাথ সমেত গোটা টিম নিয়ে সারা তল্লাট জুড়ে ঘোরা হয়েছে। হঠাৎ যে সেই লরিতে কেন সদানন্দবাবুকে তুলে দেওয়া হয়েছিল, ঈশ্বর জানেন; তবে ছেলেছোকরাদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে তিনিও দেখলুম সমানে চেঁচাচ্ছেন : শিন্ড ফাইনাল জিতল কে, শক্তিগড় ইউনাইটেড আবার কে। বার কয়েক পাড়া প্রদক্ষিণ করে ছেলেছোকরার দল দত্তবাড়ির সামনে এসে জমায়েত হবার পরে তাদের মধ্যে ল্যাংচা বিতরণের পর্বও শেষ হয়েছে। এ-দিক ও-দিক থেকে তার পরেও যে জয়ধ্বনি উঠছে না, তা নয়, দু-চারটে বোমা-পটকাও ফাটছে মাঝে-মধ্যে, তবে খানিক আগের সেই মত্ত ভাবটা এখন আর নেই।