“কী বলছে?”
“বলছে যে, ওর পকেটমার হয়েছে! ভাবা যায়?”
“সে কী!” ভাদুড়িমশাই কিছু বলবার আগেই সদানন্দবাবু বললেন, “পকেটমার! সে তো কলকাতার ময়দানে বড় খেলার লাইন পড়লে হয় শুনেছি; আই. এফ. এ. ভার্সাস ইসলিংটন কোরিন্থিয়ানসের খেলার দিনে আমার মেজো মামাবাবুর যেমন হয়েছিল। টিকিট কাউন্টার অব্দি পৌচে দ্যাকেন যে, পকেট ফাঁক, ভিড়ের মদ্যে কে যেন তার মানিব্যাগ তুলে নিয়েছে, তাতে নগদ দশ আনা তিন পয়সা ছিল মশাই, সেটা হাপিস হয়ে যাওয়ায় মেজো মামাবাবুর আর টিকিট কেটে ভেতরে ঢোকা হল না, মাঠ থেকে শিকদারবাগান অলি হাঁটতে-হাঁটতে ফিরতে হল। কিন্তু সে তো কলকাতার পথেঘাটে হামেশাই ওসব হচ্ছে। বাট দিস ইজ নট ক্যালকাটা, এখানে কোত্থেকে পকেটমার আসবে।”
কৃপানাথ বললেন, “সেটাই হচ্ছে কথা! ব্যাটা আসলে এখানকার লোকদের এগেনস্টে একটা দুর্নাম রটিয়ে দেবার তালে রয়েছে। কিন্তু আমাদের লোক্যাল ছেলেরা যদি এটা টের পায়…মানে..”
কথাটা শেষ করতে গিয়েও শেষ করলেন না কৃপানাথ, এদিকে-ওদিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বললেন, “সবই তো বোঝেন।”
সদানন্দবাবু একটা বিপদ ঠিকই আঁচ করেছিলেন, এটাও বুঝেছিলেন যে, কথাবার্তা এখন একটু নিচু গলায় হওয়াই বাঞ্ছনীয়, কিন্তু বিপদটা যে কী হতে পারে, সেটাই ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না। কৃপানাথের দিকে একেবারে ভ্যাবলার মতো খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে তততধিক চাপা গলায় তিনি বললেন, “কী বুজব?”
ওদিকে ততক্ষণে সেকেন্ড হাফের খেলা শুরু হয়ে গেছে। সদানন্দবাবুর কথার উত্তর দিয়ে কৃপানাথ বললেন, “কাণ্ড দেখুন, আমাদের ছেলেগুলো তো একেবারেই অ্যাটাকে যাচ্ছে না। এদের হল কী! কোথায় ওদের এরিয়ার দখল নিবি, তা নয়, গুটিয়ে গিয়ে নিজেদের এরিয়ার মধ্যেই জট পাকিয়ে ঘুরছে।”
ভাদুড়িমশাই বলেলন, “এটা হয়তো ইচ্ছে করেই করছে।”
“কেন, কেন, ইচ্ছে করে করবে কেন,” সদানন্দবাবু বললেন, “ওরা…আই মিন পোড়াবাজার যেমন এদের গোল-এরিয়ায় এসে হানা দিচ্ছে, তেমনি এদেরও তো ওদের এরিয়ায় গিয়ে হামলা করা উচিত।”
সদানন্দবাবুর অনেক কথাতেই আমি সায় দিই না, কিন্তু এই কথাটায় দিতেই হল। ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললুম, “সদানন্দবাবু তো ভুল বলেননি। অলরেডি যে ওরা পাঁচ-পাঁচটা কর্নার পেয়েছে, সেটা খেয়াল করেছেন?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা করেছি বই কী।”
“ওর যে-কোনও একটা থেকে গোল হয়ে যেতে পারত।
“কিন্তু হয়নি যে, সেটাই হচ্ছে আসল কথা।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “খেয়াল করে দেখুন, এতগুলো কর্নার পেয়েছে ওরা, সেই সঙ্গে গোল বক্সের একটু বাইরে থেকে দু দুটো ফ্রি-কিকও পেয়েছে, কিন্তু কোনওটা থেকেই কিছু ফয়দা তুলতে পারেনি। এদিকে আবার এই যে ওরা বার-বার এসে এদের গোলবক্সে হানা দিচ্ছে, এতে যে ওদের শক্তি ক্ষয় হচ্ছে, দম ফুরিয়ে আসছে, ফলে আক্রমণের ঝাঁঝও ক্রমেই কমে যাচ্ছে, সেটা তো কারও না বোঝার কথা নয়।”
কথাটা ভাদুড়িমশাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন ঠিকই, তবে কিনা বললেন আসলে আমাদের সকলের উদ্দেশেই। কৃপানাথ তাঁর কথার পিঠে কিছু একটা মন্তব্য করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তিনি মুখ খুলবার আগেই বছর একুশ-বাইশের কালো, লম্বা, লোহা-পেটানো পেশল শরীরের একটি ছেলে এসে বলল, “জ্যাঠামশাই, আর তো সহ্য হচ্ছে না!”
কৃপানাথের মুখ দেখে মনে হল, তিনি ভয় পেয়ে গেছেন। শুকনো গলায় বললেন, “কেন, নতুন করে আবার কী হল?”
“ওদের কোচটা বলছে যে, যেখানে এলে পকেট মারা যায়, টিম নিয়ে সেই চোর ছ্যাচড়দের জায়গায় খেলতে আসাই উচিত হয়নি।”
“আহাহা, এতে এত রেগে যাচ্ছিস কেন?” ছেলেটিকে শান্ত করার ভঙ্গিতে কৃপানাথ বললেন, “সকলের সব কথা কি ধরতে আছে! আপন মনে তো কত জনে কত কথাই বলে, সে-সব কথা কানে না নিলেই হল!”
“আপন মনে বলেনি জ্যাঠামশাই! চেঁচিয়ে পাঁচজনকে শুনিয়ে বলছিল!”
“তুই নিজের কানে শুনেছিস?”
“আমি শুনিনি, তবে শঙ্কর আর ন্যাপাকে তো আমি ওর খুব কাছেই দাঁড় করিয়ে রেখেছিলাম, তারা শুনেছে। বলেন তো দু’ঘা লাগিয়ে দিই।”
“আরে না না,” কৃপানাথ শিউরে উঠে বললেন, “ও-সব করতে যাস না। বাইরের টিমের কোচের গায়ে আমরা হাত তুলেছি, এটা যদি রটে যায় তো কী হবে জানিস?”
“কী হবে?”
“বাইরে থেকে কোনও টিমই আর কখনও এই টুর্নামেন্টে খেলতে আসবে না। না না, যে যা-ই বলুক, তোরা বাবারা একটু শান্ত হয়ে থাক তো।”
“ঠিক আছে জ্যাঠামশাই,” ছেলেটি বলল, “আপনি যখন এত করে বলছেন, আমাদের ছেলেগুলোকে তখন সামলে রাখার চেষ্টা করছি। কিন্তু ফের যদি ও-লোকটা ওই রকমের কথা বলে, তা হলে কিন্তু আগুন জ্বলবে।”
সদানন্দবাবু যে ঘাবড়ে গেছেন, সে তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। ছেলেটি চলে যেতে সেই আগের মতো চাপা গলায় কৃপানাথবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন “কী ব্যাপার মশাই? সত্যি-সত্যি আগুন জ্বলবে নাকি?”
কিন্তু কৃপানাথবাবুর কাছ থেকে এবারেও কোনও স্পষ্ট উত্তর পাওয়া গেল না। এবারেও তিনি সেই আগের মতোই নিস্তেজ, নেতিয়ে পড়া গলায় বললেন, “সবই তো ববাঝেন।”
সদানন্দবাবুর খেলা দেখার উৎসাহ চলে গিয়েছিল। ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “একটা কতা জিগেস করচি, কিছু মনে করবেন না, খেলাটা কি শেষ পর্যন্ত দেকতেই হবে?”