ব্যাপারটা মাঝে-মাঝে সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তবু যে কোনও বড় রকমের গণ্ডগোল ঘটছিল না, তার দুটো কারণ। প্রথমত, মাখন শিকদার সত্যিই বেশ কড়া মেজাজের রেফারি। খেলা শুরু হবার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই দেখলুম, পিছন থেকে বিপজ্জনকভাবে ট্যাক্স করার জন্যে দু’ দলের দু’জন খেলোয়াড়কে তিনি হলুদ কার্ড দেখিয়ে দিলেন। তা ছাড়া, পোড়াবাজারের কোচটি হঠাৎ একবার তার একজন খেলোয়াড়কে বিকট চেঁচিয়ে কিছু নির্দেশ দিতেই রেফারি সঙ্গে-সঙ্গে খেলা থামিয়ে কোচটির কাছে এসে প্রচণ্ড একটা ধমক দিয়ে বললেন, “যদি আপনার কাউকে কিছু বলার থাকে তো হাফ-টাইমে বলবেন; এখন যদি এইরকম যাঁড়ের মতন চেঁচান, তো মাঠের ধার থেকে আমি আপনাকে উঠিয়ে দেব।” কোচটির গলা তারপরে আর শোনা যায়নি। বোধহয় তিনি বুঝে গিয়েছিলেন যে, শক্ত লোকের পাল্লায় পড়েছেন, চেঁচামেচি করে এখানে বিশেষ সুবিধে হবে না।
পোড়াবাজার ফরোয়ার্ড লাইনের সেই ছেলে দু’টিকে সেমিফাইনাল খেলায় খুব লাফ ঝপ করতে দেখেছিলুম। পরস্পরের সঙ্গে ভাল রকমের বোঝাঁপড়া রয়েছে, দু’জনেই চমৎকার বল-প্লেয়ার, নিজেদের মধ্যে বল দেওয়া-নেওয়া করতে করতে এমন চমৎকারভাবে ওরা মাঝে-মাঝে আক্রমণে উঠে আসছিল যে, তাতেই চেনা যাচ্ছিল ওদের জাত। আক্রমণ আটকে যাবার পরে বল যখন আবার তাদের সীমানায় ফিরে যাচ্ছে, তখন ডিফেন্সে যাতে বড় রকমের কোনও ফঁক-ফোকর দেখা না দেয়, তার জন্য ওরা নেমেও যাচ্ছিল খুব তাড়াতাড়ি। দু’জনেরই দু’পা দেখলুম সমান চলে। সেটাও একটা মস্ত কারণ, যার জন্যে হঠাৎ-হঠাৎ জায়গা পালটে খেলতে ওদের কোনও অসুবিধে হচ্ছিল না। কিন্তু ওই যে বললুম, সেমিফাইনালের দিন ওরা যেরকম লাফ-ঝাঁপ করছিল, আর মাঝে-মাঝে একেবারে বুলডোজারের মতো ঢুকে পড়ছিল বিপক্ষের ব্যুহের মধ্যে, আজ সে রকম কিছু একবারও দেখতে পাইনি। শেষের দিকে এমনও মনে হচ্ছিল যে, ওদের দম ফুরিয়ে গেছে। দু’জনেরই দৌড়ের মধ্যে যে ভয়ংকর, প্রায় অবিশ্বাস্য রকমের, গতি সে দিন দেখেছিলুম, যতই ভাল খেলুক, সেই গতির অর্ধেকও আজ দেখতে পাচ্ছিলুম না।
বরং সেই তুলনায় ভূতনাথের খেলা দেখে তাক লেগে যাচ্ছিল আমাদের। সদানন্দবাবু সে-কথা বললেনও। “আরে মশাই, এ তো দেকচি মেওয়ালালের মতো খেলচে।” আমরা যেখানে বসে আছি, সেখান থেকে চেঁচিয়ে কাউকে সমর্থন করলে সেটা একটু অশোভন ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। সদানন্দবাবু যে তা জানেন না, তা নয়। কিন্তু ভূতনাথের খেলা দেখে তার মধ্যে যে আবেগ জমে উঠেছে, কতক্ষণ সেটাকে চাপা দিয়ে রাখবেন। তার চাপ সামলাতে না পেরে মাঝে-মাঝে, নিজের হাঁটু মনে করে, আমার হাঁটুতেই মস্ত এক-একটা চাপড় মেরে তিনি চেঁচিয়ে উঠছিলেন, “ওহোহোহো, এ কী খেলা খেলছিস রে ভূতত। চালিয়ে যা! চালিয়ে যা!”
ওদিকে, ফরওয়ার্ড লাইনের ছেলে দুটোর স্পিড কমে যাওয়ায়, আর তার ফলে পিছন থেকে যে-সব বল বাড়ানো হচ্ছে, চটপট জায়গামতো ছুটে গিয়ে সেগুলো ট্র্যাপ করতে না পারায়, পোড়াবাজারের আক্রমণ আজ ঠিক জমাট বাঁধতে পারছিল না। স্রেফ গতির অভাবেই তাদের মুভমেন্টগুলো শুরু হতে না হতেই ঝিমিয়ে যাচ্ছিল। আর তার সুযোগ নিচ্ছিল ভূতনাথের টিম। কৃপানাথ ভেবেছিলেন, পোড়াবাজারের বিরুদ্ধে তাদের টিম একেবারে দাঁড়াতেই পারবে না, সুলতানপুরের মতো তাদের কপালেও অশেষ দুর্ভোগ লেখা রয়েছে, তারাও পাঁচ-ছ গোলে হারবেন। কিন্তু আজ দেখা গেল, অত ভয় পাবার কিছু ছিল না, দক্ষতার বিচারে দুটো দলই আসলে সমান-সমান। কেউই কারও চাইতে বিশেষ এগিয়ে বা পিছিয়ে নেই।
লড়াইটাও তাই হাড্ডাহাড্ডি রকমের হচ্ছিল। দুই হাফ মিলিয়ে মোট নব্বই মিনিটের খেলা। তার অর্ধেক সময় কেটে গেছে, কিন্তু গোল হয়নি। পোড়াবাজারের মানিকজোড়ের একজন ইতিমধ্যে একটা সিটার’ নষ্ট করেছে। শক্তিগড় তেমন কোনও সহজ সুযোগ পায়নি। পাবার কথাও নয়। কেননা, আদৌ উঠে না গিয়ে যেভাবে তারা নিজেদের এলাকাতেই লোক বাড়িয়ে রেখেছে, তাতে মনে হচ্ছে আপাতত তাদের লক্ষ্য হচ্ছে গোল না খাওয়া।
হাফটাইমে দেখলুম পোড়াবাজারের কোচ হাত-পা নেড়ে বেশ উত্তেজিত ভঙ্গিতে তার টিমের ছেলেদের কিছু বলছেন। কৃপানাথ এতক্ষণ দোয়ার তলায় আমাদের সঙ্গে বসে খেলা দেখছিলেন। এস. ডি. ও. সাহেব যেহেতু বিরতির পরে আর থাকতে রাজি হলেন না, কৃপানাথ তাই তাকে তার জিপ পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গেলেন। তাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে, দু’পক্ষের খেলোয়াড়দের বরফ আর কোল্ড ড্রিঙ্কস ঠিকমতো দেওয়া হয়েছে কি না, তার খোঁজখবর নিয়ে ফিরেও এলেন মিনিট পাঁচেকের মধ্যে। এসে বেজার মুখে বললেন, “একটা বড় বিচ্ছিরি ব্যাপার হয়েছে।”
বললুম, “এর মধ্যে আবার কী হল? কেউ জখম-টখম হয়নি তো?”
“না না, ইনজুরির ব্যাপার নয়।”
“তা হলে?” ভাদুড়িমশাই বললেন, “পোড়াবাজার থেকে বাস ভর্তি করে যে-সব সাপোর্টার এসেছে, তারা কোনও গণ্ডগোল বাধাবার তালে নেই তো?”
“আরে না, ওদের সাপোর্টাররা খুব ভালই জানে যে, গণ্ডগোল বাধিয়ে এখানে বিশেষ সুবিধে হবে না।”
“তা হলে?”
“আর বোলো না ভাই!” কৃপানাথ বললেন, “ওদের ওই কোচ ব্যাটাচ্ছেলে কী বলছে জানো?”