যা-ই হোক, কালকের দিনটা দুপুরে মাছ ধরে আর বিকেল থেকে রাত্তির অব্দি ব্রিজ খেলে দিব্যি কেটেছে। আর আজকের দিনটার কথা তো ভোলা যাবে না। দিনটা ছিল উত্তেজনায় ঠাসা, বিকেলে খেলার মাঠে যা কিনা একেবারে চরমে উঠে যায়। কৃপানাথ দত্ত টুর্নামেন্ট কমিটির প্রেসিডেন্ট, প্রথম থেকেই তিনি ভয়ে-ভয়ে ছিলেন যে, একটা হাঙ্গামা হয়তো বেধে যেতে পারে, আর যদি বাধে তো সেটা নেহাত খেলার মাঠে আটকে থাকবে না। পোড়াবাজার টিমের সঙ্গে যে তিনটে বাস ভর্তি করে তাদের শ’খানেক সাপোর্টারও খেলার মাঠে এসে পৌঁছেছে, এই খবর শুনে ভয়টা আরও বেড়ে যায়। তিনি অবশ্য কাল বিকেলেই নিজে থানায় গিয়ে দারোগাবাবুকে বলে এসেছেন যে, খেলার মাঠে তাকে উপস্থিত থাকতে হবেই, আর দারোগাবাবুও তাকে অভয় দিয়ে বলেছেন, ঘাবড়াবার কিছু নেই, পোড়াবাজার থেকে যারা আসছে, তারা যদি কিছুমাত্র গোলমাল করে তা হলে প্রথমে তিনি মাইল্ড লাঠিচার্জ করবেন, আর তাতে যদি কোনও কাজ না হয় তো ফায়ারিংয়ের অর্ডার দিতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবেন না। কিন্তু কৃপানাথের মুখ দেখে মনে হচ্ছিল, দরকার হলে দনান গুলি চালাব মশাই,’ দাবোগাবাবুর এই কথা শুনে আশ্বস্ত বোধ করবেন কী, তিনি আরও নার্ভাস হয়ে পড়েছেন।
খেলা শুরু হবার কথা কাটায়-কাঁটায় ঠিক তিনটের সময়। কিন্তু শুরু হতে বেশ কিছুটা দেরি হয়ে গেল। কেননা, তার আগে স্থানীয় ইস্কুলের প্রাইমারি সেকশনের বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা ব্যান্ড বাজাতে বাজাতে মাঠ প্রদক্ষিণ করেছে। এস. ডি. ও. সাহেব আজকের অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি; জাতি গঠনে খেলাধুলার গুরুত্ব ও খেলার মাঠে শান্তি রক্ষার প্রয়োজনীয়তা কতখানি সেটা ব্যাখ্যা করে তিনি বেশ ওজনদার একটি বক্তৃতা দিয়েছেন। স্থানীয় গ্রাম-পঞ্চায়েতের প্রেসিডেন্টও ভাষণ দিয়েছেন একটি। তাতে তিনি বলেছে যে, এককালে তিনিও খুব ফুটবল খেলতেন, তবে গত কয়েক বছর যাবৎ যেহেতু জনসেবার কাজেই তাকে অহোরাত্র ব্যক্ত থাকতে হচ্ছে, তাই ইদানীং আর খেলাধুলোর জন্যে সময় দিতে পারছেন না। ওলিম্পিকের আদর্শের কথাটা স্মরণ করিয়ে দিয়ে স্থানীয় উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গেম-টিচার বললেন, হারজিতটা কোনও কথা নয়, এই যে খেলার মাঠের প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়েছে এতগুলি দল, এই যোগদানটাই হচ্ছে আসল কথা। তিনি হয়তো আরও কিছু বলতেন, কিন্তু খেলা শুরু না হওয়া পর্যন্ত এস.ডি.ও. সাহেব যেহেতু জরুরি একটা কাজ থাকা সত্ত্বেও এখান থেকে চলে যেতে পারছেন না, তাই গেম-টিচার ভদ্রলোকের পাঞ্জাবির ঝুল ধরে বার দুই-তিন হ্যাঁচকা টান মেরে তাকে মধ্যপথেই থামিয়ে দেওয়া হল।
এর পরে শুভেচ্ছা বিনিময় পর্ব। মাঠের একদিকে একটা চাঁদোয়া খাঁটিয়ে তার তলায় পর-পর গোটা কুড়ি চেয়ার পেতে তাতে অভ্যাগতদের বসানো হয়েছে। দুই দলের খেলোয়াড়দের সঙ্গে এবার আজকের অনুষ্ঠানের সভাপতি ও প্রধান অতিথির পরিচয় করিয়ে দেওয়া হবে। খেলোয়াড়রা মাঠের মাঝখানে মুখোমুখি দুই সারিতে দাঁড়িয়ে আছেন। দুই টিমের কোচও দাঁড়িয়ে আছেন নিজের নিজের খেলোয়াড়দের পাশে। কৃপানাথবাবু এসে ভাদুড়িমশাই ও এস. ডি. ও. সাহেবকে সেখানে নিয়ে গেলেন। পরিচয়পর্ব সাঙ্গ হতে লাগল তা অন্তত মিনিট দশেক। আমরা দূর থেকে দেখলুম যে, ভাদুড়িমশাই ও এস. ডি. ও. সাহেব খেলোয়াড়দের প্রত্যেকের সঙ্গে করমর্দন করতে করতে একটি দু’টি কথা বলছেন। কোচ দু’জনকে তো ভাদুড়িমশাই জড়িয়ে ধরলেনও।
এই যে পরিচয়পর্ব আর শুভেচ্ছা বিনিময়, খেলার মাঠে এর দরকার আছে বই কী। এটা আসলে একটা প্রতাঁকের মতো। মৈত্রীর প্রতীক। যেন এই প্রতাঁকের মাধ্যমেই বলে দেওয়া হচ্ছে যে, এখন আমরা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী ঠিকই, কিন্তু আসলে আমরা সবাই পরস্পরের বন্ধু। তাই দয়া করে কেউ যেন কোনও গণ্ডগোল কোরো না, খেলাটাকে নির্বিঘ্নে শেষ হতে দাও। যেন, ফলাফল যা-ই হোক না কেন, কারও মনে কোনও তিক্ততার রেশ থেকে না যায়।
শুভেচ্ছা বিনিময়ের এই পর্বের সঙ্গে যেমন খেলোয়াড়দের, তেমন দু’দলের কোচকেও যে জড়িয়ে দেওয়া হল, এর পিছনে কার মাথা কাজ করেছে, জানি না। তবে যার মাথাই কাজ করে থাক, সেটা যে পাকা মাথা, তাতে সন্দেহ নেই। কথাটা এই জন্যে বলছি যে, কোচদের উশকানির জন্যেই অনেক সময় খেলার মাঠে হাঙ্গামা বেধে যায়। খেলা যখন চলছে, তখন মাঠের ধারে বসে এমনভাবে তাদের অনেকে গলা ফাটিয়ে খেলোয়াড়দের তাতাতে থাকেন যে, তাতেই বেড়ে যায় উত্তেজনা। এমন কোচও দেখেছি, একটু ধৈর্য ধরে যাঁরা বসে থাকতেও পারেন না, মাঠের ধার বরাবর দৌড়তে দৌড়তে যাঁরা চেঁচাতে থাকেন। মনে হল, খেলা শুরু হবার আগে ভাদুড়িমশাই ওই যে দুই টিমের দুই কোচকে অত আদর করে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, এতেও শান্তি রক্ষার কাজ হবে কিছুটা। আর যা-ই করুন, এর পরে আর ওঁরা নিজের নিজের টিমকে এমনভাবে উত্তেজিত করবেন না, যার ফলে একটা হাঙ্গামা লেগে যেতে পারে।
কার্যত অবশ্য দেখা গেল যে, স্থানীয় টিমের কোচটি চুপ করে বসে খেলা দেখছেন বটে, কিন্তু পোড়াবাজারের কোচটির ক্ষেত্রে ভদ্রতা করে কোনও লাভ হয়নি। সেমিফাইনাল খেলার দিনে সুলতানপুরের বিরুদ্ধে তার খেলোয়াড়দের, বিশেষ করে ফরোয়ার্ড লাইনের সেই দুর্ধর্ষ খেলোয়াড় দুটিকে যেভাবে তিনি উশকে দিয়েছিলেন, আজও সেইভাবে উশকে যাচ্ছেন।