“আরে দূর মশাই, সদানন্দবাবুকে বাধা দিয়ে আমি বললুম, “অত বাঙালি-বাঙালি করছেন কেন? পোড়াবাজার টিমের ছেলেগুলো কি বাঙালি নয়? তবে হ্যাঁ, ওদের বডি ফিটনেস যে তারিফ করার মতো, সেটা বলতেই হবে। ইন ফ্যাক্ট, আজকের খেলায় সুলতানপুর টিমের সঙ্গে ওটাই ওদের একটা মস্ত তফাত গড়ে দিয়েছিল।
“পরশুও দেবে!” কৃপানাথ বললেন, “তবে সুলতানপুরের মতো পাঁচ গোলে না হেরে যাই। ওইরকম গোহার হারলে আর মুখ দেখানো যাবে না।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “এখুনি হারের কথা উঠছে কেন? ভুতোবা খেলবে তো?”
“তা খেলবে। ছোট-বউমাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আমি রাজি করাতে পারব। কিন্তু একা ভুতেই বা কী করবে। ও দুটো ষণ্ডাকে একা সামলানো ওর কম নয়।”
“ও কেন সামলাবে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “ওদের পিছনে আর-দু’জনকে লাগিয়ে রাখো, ভুতোবাবু যাতে নিজের খেলাটা খেলতে পারে।”
সদানন্দবাবু বললেন, “সেই সঙ্গে রেফারিকেও একটু টিপে দিন না!”
কৃপানাথ বললেন, “তার মানে?”
“মানে আর কী, সবই তো বোজেন, এই বাজারে সব জায়গাতেই যা হচ্ছে আর কী..আরে মশাই, খেলা শুরু হবার আগে রেফারিকে একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে…”
“আরে ছি ছি,” কৃপানাথ দাঁতে জিভ কেটে, দু হাতের বুড়ো আঙুল দুই কানের লতিতে ছুঁইয়ে বললেন, “ঘুষ দেবার কথা বলছেন তো? আরে রাম রাম, ও-সব চিন্তাকে মাথায় ঠাই দেবেন না মশাই!”
“কেন,” সদানন্দবাবু বললেন, “পরশুর খেলায় কি ধর্মপুর যুধিষ্ঠির এসে রেফারি হচ্চে নাকি?”
শুনে আমরা হাসলুম বটে, কিন্তু কৃপানাথ হাসলেন না। বললেন, “সরকারি ইঞ্জিনিয়ার মাখন শিকদারকে যদি চিনতেন তো এমন কথা আপনি বলতেন না বোসমশাই।”
“তার মানে?”
“মানে আর কিছুই নয়, পরশুর খেলা নডাক্ট করছে মাখন শিকদার, যার অনেস্টি একেবারে আনকোয়েশ্চেনেবল। যুধিষ্ঠির তো তাও একবার কায়দা করে একটা ডিজনেস্ট কাজ করেছিলেন…এই হত ইতি গজর কথাটা বলছি আর কি, কিন্তু মাখন শিকদার বোধহয় তাও কখনও করেনি।”
“বটে?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ। বিশ্বেস না হয় তো যতীন ঘোষকে জিজ্ঞেস করে দেখুন।”
“যতীন ঘোষ আবার কে?”
“একজন ঠিকেদার।” কৃপানাথ বললেন, “ঘুষ দিয়ে একটা ব্রিজ মেরামতির টেন্ডার বাগাবার তালে ছিল। তাও যে সত্যি-সত্যি ঘুষ দিয়েছিল, তা নয়, স্রেফ হাত কচলাতে কচলাতে মাখন শিকদারকে বলেছিল যে, কাজটা যদি পায় তা হলে শিকদার-মশাইয়ের বেকার শালাটিকে সে…। বাস, আর কিছু বলার দরকার হয়নি, ওই যে ইঙ্গিতটুকু করেছিল, ওরই জন্যে যতীন ঘোষ ব্ল্যাক লিস্টেড হয়ে যায়। গত দু বছরে লোকটা একটাও সরকারি কাজ পায়নি।… না না, ওকে কিছু বলতে গেলে হিতে বিপরীত হবে।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “এমনিতেও ও-সব নোংরামির মধ্যে যাওয়া ঠিক হবে না। কিন্তু একটা কথা জিজ্ঞেস করি। লোকটি পাস-করা রেফারি তো?”
“অফ কোর্স।” কৃপানাথ বললেন, “তা নইলে ওকে দায়িত্ব দেব কেন?”
“ভাল কথা। কিন্তু শুধু পাসকরা রেফারি হলেই তো হয় না, ধাঁচটা কেমন?”
“তার মানে?”
“মানে জবরদস্ত লোক কি না।” ভাদুড়িমশাই মৃদু হেসে বললেন, “মানে… আরও পরিষ্কার করে বলছি… বেশ শক্ত হাতে খেলাটা কনডাক্ট করতে পারবে কি না।
“তা পারবে।” কৃপানাথ বললেন, “এর আগে কোয়ার্টার ফাইনালের একটা ম্যাচ কনডাক্ট করেছিল। একটা গোল নিয়ে হাঙ্গামা বাধার উপক্রম হয়েছিল সেদিন। গোলটা যারা খেয়েছিল, তাদের একজন স্টপার এগিয়ে এসে রেফারির ডিসিশান নিয়ে আপত্তি জানাতেই মাখন শিকদার তাকে লাল কার্ড দেখিয়ে দেয়।… না না, বেশ কড়া লোক।”
“ভাল কথা।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “এখন একটু ঘরে চলল, তোমার সঙ্গে আর দু একটা কথা সেরে নেওয়া দরকার।”
“এঁরা?” কৃপানাথ বললেন, “এঁরা কি এখানেই থাকবেন?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, এমন চমৎকার বাতাস এঁরা কোথায় পাবেন। বারান্দায় বসে এঁরা যেমন গল্প করছেন করুন, সেই ফাঁকে আমরাও আমাদের পুরনো দিনের স্মৃতি রোমন্থন করে নিই।”
কৃপানাথকে সঙ্গে নিয়ে ভাদুড়মশাই বারান্দা থেকে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লেন। তবে তার উদ্দেশ্য যে শুধুই স্মৃতি রোমন্থন, তা আমার মনে হল না।
.
॥ ৪ ॥
আজ ১৩ এপ্রিল, রবিবার। বাংলা ১৩০৩ সনের আজই ছিল শেষ দিন। কাল থেকে নতুন বছর শুরু হবে। বাংলা নববর্ষে আগে ছুটি পাওয়া যেত না, আজকাল কিন্তু যাচ্ছে, তাই ফলকের দিনটাও দিব্যি এখানে কাটানো যেত, কিন্তু ভাদুড়িমশাই কিছুতেই রাজি হচ্ছেন না, বলছেন, ওরে বাবা, তাই কখনও হয়? কেন হয় না, জিজ্ঞেস করতে বললেন, ‘মালতী একেবারে মাথার দিব্যি দিয়ে বলে দিয়েছে যে, নববর্ষের দিনটা এবারে ওদের সঙ্গে কাটাতে হবেই। কৌশিক তো বাঙ্গালোরে, এখন আমিও যদি পয়লা বৈশাখটা বাইরে কাটাই, তা হলে ও খুব দুঃখ পাবে।”
আর-একটা দিন যাতে থেকে যাই, তার জন্যে কৃপানাথ দত্ত গোড়ায়-গোড়ায় খুব ঝুলোবুলি করছিলেন ঠিকই, সেই সঙ্গে এ বাড়ির অনন্যরাও খুবই চাইছিল যে, কালকের দিনটাও এখানে থাকি, কিন্তু ভাদুড়িমশাই যখন বললেন, ছোট বোনের কাছে তা হলে কথার খেলাপ হয়ে যাবে, তখন আর কেউ আপত্তি করলেন না। ভূতনাথ অবশ্য কথা আদায় করে নিল যে, অক্টোবর মাসে পুজোর কটা দিন তাদের বাড়িতে এসে কাটিয়ে যেতে হবে। ভাদুড়িমশাই বললেন যে, সেই সময়ে যদি বাঙ্গালোরের আপিসে খুব বেশি কাজ পড়ে না যায়, একমাত্র তা হলেই তাঁর কলকাতায় আসা সম্ভব হবে, আর কলকাতায় যদি আসেন তো শক্তিগড়ে এসে তিনটে দিন কাটিয়ে যাবেন ঠিকই। আর আমাদের তো না আসার কোনও কথাই ওঠে না। পুজোর কলকাতা থেকে বেরিয়ে পড়তে পারলে তো আমরা বেঁচে যাই।