আবার এবার নিয়ে পরপর তিন বার আমরা ফাইনালিস্ট। গত দু’ বছর অল্পের জন্যে ট্রোফি ফশকে যায়। এবারে কী হবে কে জানে।”
ভাদুড়িমশাই তালুতে জিভ ঠেকিয়ে চুকচুক করে আক্ষেপ প্রকাশ করে বললেন, “এবারেও বোধহয় ফসকে যাবে।”
“একথা কেন বলছ?”
“বলছি পোড়াবাজার টিমের ফরোয়ার্ড লাইনের খেলা দেখে।”
সদানন্দবাবু বললেন, “বিশেষ করে ও-দুটো ছোঁড়ার তো কোনও তুলনাই হয় না। ওরে বাপ রে বাপ, ওদের দেকে তা আমার লক্ষ্মীনারায়ণ আর মুর্গেশের কম্বিনেশনের কতা মনে পড়ে যাচ্ছিল। আর কিকের জোর যা দেকলুম, একেবারে পাগলির মতো।”
“লক্ষ্মীনারায়ণ-মুর্গেশের খেলা আমি দেখিনি,”ভাদুড়িমশাই বললেন, “পাগলিরও না, তবে সোমানা-আপ্পারাওয়ের খেলা তো দেখেছি। না হে কৃপানাথ, আজ ওরা যা খেলল, পরশু যদি তার অর্ধেকও খেলতে পারে তো তোমার… মানে শক্তিগড়ের নো চান্স।”
কৃপানাথ দত্ত একেই মুষড়ে ছিলেন, ভাদুড়িমশাইয়ের কথা শুনে আরও নেতিয়ে পড়লেন। সেই অবস্থাতেও, সম্ভবত নিজেই নিজেকে একটু সাহস জোগাবার জন্যে, মজ্জমান ব্যক্তি যে-ভাবে হাতের সামনে যা-কিছু পায়, তা-ই আঁকড়ে ধরে, সেইভাবে বললেন, “অবিশ্যি আমাদের টিমও মোটেই ফ্যালন নয়। ভুতোর… মানে বিশ্বনাথের ছেলের খেলা তো তুমি দ্যাখোনি, দেখলে বুঝতে পারতে যে, ওই রকমের বডি-ফিটনেস আর স্টামিনা না-ই থাক, স্রেফ ট্যালেন্ট আর ফুটবল-সেন্সের কথা যদি ওঠে, তো ভুতো ওদের চেয়ে একটুও পিছিয়ে নেই, বরং দু’কদম এগিয়ে আছে। কিন্তু মুশকিল কী জানো, পাওয়ার-টেনিসের মতো এ হল পাওয়ার-ফুটবলের যুগ। যার যত মাল-পাওয়ার, খেলার মাঠে তার তত দাপট।… নাঃ, ওই মা-ম্যান দুটোই পোড়াবাজারকে জিতিয়ে দেবে, এবারেও আমরা পারলুম না!”
বললুম, “এত হতাশ হচ্ছেন কেন? আজ ভাল খেলেছে বলেই যে পরশুও ওরা ভাল খেলবে, তার তো কোনও মানে নেই। আমাদের কলকাতা ময়দানের নামজাদা সব ফুটবলারদের দেখছেন তো, পরপর দুদিন ওরা কেউ ভাল খেলে না। আজ যদি বাঘের মতো খেলল, তো কাল হয়তো খেলবে শেয়ালের মতো। না না, আপনি এত দমে যাবেন না তো।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “ভূতোবাবুর কথা বলছিলে। ওর খেলা তো দেখিনি। ওদের সেমিফাইনালের খেলা কবে ছিল?”
“গত সোমবার। সেদিন একসট্রা টাইম খেলানো হয়েছিল। তাও খেলাটা ড্র থেকে যায়। ফলে পরও… মানে বুধবার আবার খেলতে হয়। সেদিনও ড্র হতে যাচ্ছিল, কিন্তু একসট্রা টাইমের তিন মিনিটের মাথায় ভূতো কী বলব, অলমোস্ট আনবিলিভেবলি– একটা গোল করে বসে। সেই গোল্ডেন গোলেই আমরা জিতে যাই।”
“গোলটাকে অবিশ্বাস্য বলছ কেন?”
“এইজন্যে বলছি যে, মাঠের যে-হাফে আমরা খেলছিলুম, সেখান থেকেই একটা গ্রু পাস ধরে নিয়ে বিপক্ষের পরপর পাঁচজনকে কাটিয়ে বল নিয়ে ভূতো ওদের বক্সের মধ্যে ঢুকে পড়ে, তারপর যেন ডান পায়ে শট নিতে যাচ্ছে, এইভাবে বাঁ দিকে ঝুঁকে পড়ে সেই অবস্থাতেই বাঁ পায়ে শট নেয়। গোলকিপারের কিছু করার ছিল না, কেননা, ভুতোর ওই বাঁ দিকে ঝোকা দেখেই সে কমিটেড হয়ে গিয়েছিল।”
বললুম, “গত ওয়র্লড কাপে আফ্রিকার একজন ফুটবলারকে এগেস্ট দ্য রান অব দ্য প্লে ওইভাবে একটা গোল করতে দেখেছি। সেও একেবারে একার চেষ্টায় গোল করা।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “রাইট। গোলটা টিভিতে আমিও দেখেছিলুম। ইন ফ্যাক্ট দ্যাট। ওয়াজ অ্যাডজাজড টু বি দ্য বেস্ট গোল অভ দ্য টুর্নামেন্ট।… কিন্তু সে-কথা থাক। ভুতোর কথা হচ্ছিল। ওর খেলা আমি দেখিনি, তবে ওর মতো বয়েসে ওর বাপ কেমন খেলত, তা তো জানি। বিশ্বনাথের ফুটবল-ট্যালেন্টের অর্ধেকও যদি ভূতোবাবু পেয়ে থাকে, তো বলব, দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে তোমাদের হারতে হবে না, ইট ওন্ট বি আ ওয়ন সাইডেড অ্যাফেয়ার।”
কৃপানাথ বললেন, “আমি তো সেই ভরসাতেই রয়েছি, তবে বাইরে যে সেটা প্রকাশ করব, এমন সাহস পাচ্ছি না। তা ছাড়া এদিকে আবার আর-একটা ঝাট বেধেছে।”
“কিসের ঝঞ্ঝাট?”
“ঝঞ্ঝাট আমাদের ভুতোর মা অর্থাৎ ছোট বউমাকে নিয়ে।”
“এর মধ্যে আবার তিনি কী করে আসছেন?”
“আসছেন ভুতোর জন্যে।” কৃপানাথ একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “কে যেন তার কানে তুলে দিয়েছে যে, পোড়াবাজার টিমে দুটো জল্লাদ-মার্কা ছেলে আছে, ভুতো যদি খেলতে নামে তো তার ঠ্যাং না ভেঙে তারা ছাড়বে না।”
“তাই কী হয়েছে?”
“এই হয়েছে যে, বউমা কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছেন। তার ইচ্ছে নয় যে, ফাইনাল খেলায় ভূতোকে আমরা মাঠে নামাই।”
একটুক্ষণ থেমে রইলেন কৃপানাথ। তারপর বললেন, “আসলে ব্যাপারটা কী হয়েছে জানো, খেলার মাঠে বিশ্বনাথ একবার মাথায় খুব চোট পেয়েছিল, মাঠ থেকে সরাসরি ওকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়। মারাত্মক ইনজুরি, কনকাশন হয়েছিল, বাঁচবার আশা ছিল না।”
“এটা কবেকার ব্যাপার?”
“বিশ্বনাথের বিয়ের পরের বছরের।” কৃপানাথ বললেন, “তারপরে আর বিশ্বনাথ মাঠে নামেনি। বউমারও সেই থেকে ফুটবলের ব্যাপারে একটা আতঙ্ক জন্মে গেছে। ছেলে ফুটবল খেলছে, এমনিতেই এটা তার পছন্দ নয়। তার উপরে যেই শুনেছেন যে, ভূতের ঠ্যাং ভাঙার জন্যে পোড়াবাজার টিম একেবারে তৈরি হয়ে রয়েছে, ব্যস, আর কথা নেই, সঙ্গে-সঙ্গে কান্না জুড়ে দিয়েছেন তিনি।”
সদানন্দবাবু অনেকক্ষণ কোনও কথা বলেননি। কিন্তু এবারে আর মুখ না-খুলে পারলেন না। বললেন, “বাঙালির যে কিছু হয় না, স্রেফ এইজন্যেই হয় না। আরে বাবা, কেল্লার গোরার বুটজুতোর লাথি খেয়ে ছেলের পা ভাঙতে পারে, অভিলাষ ঘোষের মা কি তা জানতেন না? নাকি দুখিরামবাবু জানতেন না যে, কিংকং-মার্কা সায়েবের কাঁচ থেকে বল কাড়তে গিয়ে তার ভাইপো ছোনে মজুমদারের মাথা ফাটতে পারে? কিন্তু অভিলাষ ঘোষের মা কি তার জন্যে কখনও কান্নাকাটি করেছেন, নাকি দুখিরামবাবু তার আদরের ভাইপোকে ঘরের মধ্যে আটকে রেকেচেন?… না না, ভূতনাথের মা’কে সবাই গিয়ে বলতে হবে যে, এটা কোনও কাজের কতা নয়, ভূতনাথকে খেলতে দিতে হবে প্রমাণ করতে হবে যে, বাঙালি লড়তেও ভয় পায় না, মরতেও ভয় পায় না। বাঙালি যদি আজ মরার ভয়ে লড়তে না চায়, বাঙালি যদি আজ লড়ার ভয়ে…”