“গাড়িতেই যাব। সকাল ছ’টা নাগাদ বেরিয়ে পড়ব, লেবেল ক্রসিংয়ে যদি আটকে না যাই তো শক্তিগড়ে পৌঁছতে দু’ঘণ্টার বেশি লাগবে না।”
পার্বতী এসে বলল, “মা বললেন, টেবিলে খাবার দেওয়া হয়ে গেছে, আপনারা এসে বসে পড়ুন।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “হ্যাঁ রে পার্বতী, যে ছেলেটা দেখা করতে এসেছিল, তোকে যখন তার নাম বলতে বললুম, তখা তুই বললি, “সে আমি বলতে পারবনি। তার মানে তোর স্বামীর নাম নিশ্চয় ভূতনাথ। তাই না?”
শুনে, মুখ নিচু করে পার্বতী যেভাবে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল, তাতে বুঝলুম, ভাদুড়িমশাই ব্যাপারটা ঠিকই আঁচ করেছেন।
টেবিলে খেতে বসে শক্তিগড়ে যাওয়ার ব্যাপারে আর কোনও কথা হল না। খাওয়া শেষ হবার পরে ড্রয়িংরুমে ফিরে এসে বললুম, “আচ্ছা, ফুটবল টুর্নামেন্টটা বিশ্বনাথ দত্তের নামে হচ্ছে কেন? উনি কি…”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “হ্যাঁ, বেঁচে নেই। পনরো বছর আগে মারা গেছে। ভূতনাথ তখন নেহাতই বাচ্চা। বাবার কথা ওর কিছু মনে নেই।
.
॥ ৩ ॥
রবিবার রাত দশটা নাগাদ কৃপানাথ দত্তের ফোন আসতে ভাদুড়িমশাই তাকে জানিয়ে দেন যে, আমরা মোট তিনজন তার ওখানে যাচ্ছি। শুক্রবার সকাল আটটা নাগাদই যে আমরা গাড়িতে করে শক্তিগড়ে পৌঁছচ্ছি, তাও তাকে জানিয়ে দেওয়া হয়। তাতে তিনি বলেন যে, শক্তিগড়ে ঢুকে খানিকটা এগোলে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের বাঁ দিকে হেম ঘোষের মিষ্টির দোকানে ভূনাথ আমাদের জন্যে অপেক্ষা করবে।
তা আজ ১১ এপ্রিল শুক্রবার সকালে শক্তিগড়ে ঢুকে দেখলুম যে, ভূতনাথ সত্যিই আমাদের অপেক্ষায় রয়েছে। তবে আটটা নয়, পোঁছতে পৌঁছতে পৌনে ন’টা বেজে যায়। কৃপানাথ দত্তদের বাড়ি অবশ্য ঠিক শক্তিগড়ে নয়; মুখে তারা শক্তিগড়ের কথাই বলেন বটে, কিন্তু বাড়িটা আসলে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড ছেড়ে খানিকটা ভিতরে ঢুকে এমন একটা এলাকায়, যেখানে পাকা বাড়ি গোটাকয় আছে ঠিকই, কিন্তু কাঁচা বাড়ির সংখ্যা সেই তুলনায় অনেক বেশি। রাস্তাটা অবশ্য কঁচা নয়, পিচের না-হলেও খোয়া-পেটানো।
দত্তদের বাড়িটা যে অনেক কালের, চেহারা দেখলেই সেটা বোঝা যায়। দোতলা বাড়ি; সদর আর অন্দর দুটো মহলই মস্ত মাপের; প্রচুর ঘর, দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে তার কোনওটাই নেহাত ছোট নয়; সেকালের বাড়ি বলে সিলিং রীতিমতো উঁচু, জানলা দরজাও বড় বড়, ফলে ঘরগুলিতে গুমোট কিংবা দম-আটকা ভাবের সৃষ্টি হয়নি। চুন সুরকির গাঁথনির মোটা দেওয়াল বলে ঘরগুলো বেশ ঠাণ্ডাও বটে। এখানে এসে পৌঁছবার সঙ্গে-সঙ্গেই যে এত সব ব্যাপার খেয়াল করেছিলুম, তা নয়। সবই আস্তে-আস্তে দেখি, আর যতই দেখি, ততই বুঝতে পারি যে, কৃপানাথ দত্ত কেন কষ্ট করে এখান থেকে রোজ বর্ধমানে যান, কেন বর্ধমান শহরেই স্থায়ীভাবে তিনি থেকে যান না। আসলে এই ধরনের বাড়ির মধ্যে এমন একটা মায়ার ভাব থাকে, মানুষ যাতে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে যায়।
আসার পথে মগরায় খানিকক্ষণের জন্যে দাঁড়াতে হয়েছিল। রাস্তার ধারের একটা দোকানে তখন চা-বিস্কুট খেয়ে নিয়েছি। এখানে এসে হাতমুখ ধুয়ে ফের জলখাবার খেতে হল। বাড়ির পাশে মস্ত দিঘি। অনেক কাল বাদে সাঁতরে চান করা হল সবাই মিলে। তারপর মধ্যাহ্নভোজ সেরে ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়েও নিয়েছি। ঘুম থেকে উঠেছি তিনটে নাগাদ। তারপর খেলা দেখতে গিয়েছিলুম। সুলতানপুর স্পোটিং আর পোড়াবাজার ইলেভেনের সেমিফাইনাল খেলা। তাতে সুলতানপুরকে পাঁচ গোলে হারিয়ে পোড়াবাজার একেবারে ড্যাং ড্যাং করে ফাইনালে উঠে গেল। অন্য দিকের সেমিফাইনালে পলাশডাঙা ফুটবল ক্লাবকে একেবারে শেষ মিনিটে একটা গোল দিয়ে শক্তিগড় ব্রাদার্স ফাইনালে উঠেছে। কাল শনিবার খেলা নেই। পরশু রবিবার ফাইনাল।
মফস্বলের গ্রামে-গঞ্জে এইসব টুর্নামেন্ট নেহাত কম উন্মাদনা জাগায় না। যেখানে খেলা, সেখানকার স্থানীয় লোক তো বটেই, তার আশপাশের সব এলাকা থেকেও প্রচুর লোক খেলা দেখতে আসে। শুনলুম খেলার মাঠে নোজই বেশ ভিড় হয়। আজও যে হয়েছিল, সে তো স্বচক্ষেই দেখলুম। সুলতানপুর স্পোটিং যে খুব দুর্বল দল, তা নয়, এই নক-আউট টুর্নামেন্টের ট্রোফি গত বছর তারাই পেয়েছিল। কিন্তু এবারে যে সেমিফাইনালে তাদের গোহার হারতে হল, তার একটা কারণ যদি হয় রেফারির দু’ দুটো ভুল সিদ্ধান্ত, তত অন্য কারণ পোড়াবাজার টিমের ফরোয়ার্ড লাইনের দুর্ধর্ষ দুই খেলোয়াড়, বিপক্ষের ডিফেন্সকে যারা ভেঙেচুরে একেবারে তছনছ করে দিচ্ছিল।
রাত্তিরে তাই নিয়ে কথা হচ্ছিল। খাওয়ার পাট একটু আগে মিটেছে; সদর বাড়ির দোতলায় পাশাপাশি দুটো ঘরে আমাদের রাত্রিবাসের ব্যবস্থা হয়েছে; বিছানা পাতা, মশারি খাটানো, ভূতনাথের তদারকিতে সমস্ত কাজ সমাধা হয়েছে, এখন গিয়ে শুয়ে পড়লেই হয়। কিন্তু শুয়ে পড়ার ইচ্ছে কারও আছে বলে মনে হল না। আপাতত আমরা বারান্দার উপরে গোল হয়ে বসে গল্প করছি। দিব্যি ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে, সামনে পুকুর, তার জলের উপরে কোত্থেকে যেন আলো এসে পড়েছে, সব মিলিয়ে এমন একটা পরিবেশ, যাতে জেগে থাকতেই ভাল লাগে।
কৃপানাথ দত্ত বললেন, “বুঝলে হে চারু, বিশ্বনাথের নামে এই টুর্নামেন্ট চালু করেছি নাইন্টিটুতে, অথচ এর মধ্যে একবারও আমরা ট্রোফিটা ঘরে তুলতে পারিনি। এদিকে