সদানন্দবাবু বললেন, “আরে ছা ছ্যা, কৌশিক আবার এর সুখ্যাত করছিল! আরে বাবা, খেলতে নেবেছিস তো নিজের জোরে খেলে যা! সেই যেমন শিবে ভাদুড়ি আর বিজয় ভাদুড়ি খেলত, সামাদ খেলত, লক্ষ্মীনারায়ণ আর মুর্গেশ খেলত! তা নয়, তোরা কিনা নেশা করে মাঠে নাবছিস? আরে ছ্যা ছ্যা, এ-রকম নোংরামির কথা কি আগে কখনও ভাবা যেত?”
অরুণ সান্যাল বললেন, “শুধু খেলোয়াড়দের দোষ দিযেই বা লাভ কী, সাপোর্টাররাও সব তেমনি হয়েছে! কী না, আমি যার সাপোর্টার, সব খেলাতেই তাকে জিততে হবে, একটা খেলাতেও তার হারা চলবে না! আরে মশাই, তা-ই কখনও হয়? এ তো খুবই সহজ কথা, কিন্তু শুনছে কে? হারলেই মারদাঙ্গা লাগিয়ে দেব, দল বেঁধে মাঠে নেমে খেলা ভণ্ডুল করে ছাড়ব, তারপর মাঠের বাইরেও দক্ষযজ্ঞ বাধিয়ে দিতে ছাড়ব না।”
“দক্ষযজ্ঞ বলতে পারো, লঙ্কাকাণ্ডও বলতে পারো,” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “সাপোর্টারদের যা-সব স্যা ‘দেখছি, তাতে তো মনে হয়, প্যান্টুল খুললেই অনেকের ন্যাজ বেরিয়ে পড়বে!”
কৌশিক বলল, “শুধু কলকাতার সাপোর্টারদের দোষ দিচ্ছ কেন, ইংরেজ সাপোর্টারদের তুলনায় তো এরা পারফেক্ট ভদ্দরলোক। ইংল্যান্ড যখন অন্য দেশে খেলতে যায়, এই সাপোর্টাররা তখন সেখানে গিয়ে যা-সব কাণ্ড করে, তা আর কহতব্য নয়। সেই জন্যে তো ওদের বাইরে যাওয়াই বন্ধ করে দিতে হয়েছে।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তো ইংরেজদের নকল করার ঝোঁক ক্রমেই বাড়ছে। আমাদের মধ্যে কেউ-কেউ তো দেখি ইংরেজদের চেয়েও বেশি ইংরেজ! তা এবাবে খেলার মাঠে বাঁদরামির ব্যাপারেও বোধহয় ওদের আমরা ছাড়িয়ে যাব।”
আমি বললুম, “মফসসলের খেলা কিন্তু আমাদের এই কলকাতার তুলনায় অনেক ভাল। গ্রামের পুজোয় যেমন একটা শান্ত ভদ্র চেহারা এখনও চোখে পড়ে, মফস্সলের ছোটখাটো গাঁ-গঞ্জেও তেমনি দেখবেন শহরের খেলার মাঠের এই উচ্ছল ব্যাপারটা এখনও ঢোকেনি।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “বেশ তো, তা হলে আমার সঙ্গে চলুন।”
“তার মানে?”
“কৃপানাথের চিঠিখানা পড়ুন, ভাদুড়িমশাই ঠোঁট টিপে হেসে বললেন, “মানেটা তা হলেই বুঝতে পারবেন।” বলে, ভূতনাথ তার বড়-জ্যাঠামশাইয়ের যে চিঠিখানা ভাদুড়িমশাইয়ের হাতে তুলে দিয়েছিল, সেন্টার টেবিল থেকে সেটা তুলে তিনি আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। চিঠিখানা এখানে তুলে দিচ্ছি :
ভাই চারু,
সেই যে বছর ত্রিশ আগে তুমি আমাদের শক্তিগড়ের গ্রামের বাড়িতে একবার এসেছিলে, তারপরে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড দিয়ে মোটরযোগে যাতায়াতের পথে বার কয়েক বর্ধমানে আমার চেম্বারে এসে দেখা করে গিয়েছ বটে, কিন্তু গ্রামের বাড়িতে আর-কখনও আসোনি। অথচ যখনই দেখা হয়, তখন তো বটেই, চিঠিতেও বহুবার তুমি জানিয়েছ যে, শক্তিগড়ের বাড়ির সেই মধুর স্মৃতি তোমার চিত্তে এখনও অম্লান, এবং আবার তুমি সেখানে এসে কয়েকটা দিন কাটিয়ে যেতে চাও। কিন্তু কাজের চাপে কিছুতেই তোমার আসা হয় না।
কিন্তু ভাই, এবারে আর কাজের অজুহাত দিয়ো না। আজ রবিবার। আর ক’টা দিন বাদে সামনের উইকএন্ডটা এখানে এসে কাটিয়ে যাও। শনিবারের বদলে যদি শুক্রবার সকালে ট্রেনে অথবা মোটরযোগে এখানে পৌঁছে যাও তো আরও ভাল। তা হলে বিশ্বনাথের নামে আমরা এখানে যে ফুটবল টুর্নামেন্ট চালু করেছি, তার সেমিফাইনাল ও ফাইনালের খেলা তুমি দেখতে পাবে। ফাইনাল হচ্ছে রবিবার বিকেলে। তুমি প্রিসাইড করবে ও পুরস্কার বিতরণ করবে।
শক্তিগড় এখন আর সেই শক্তিগড় নেই, তুমি ভালই জানেনা। তবে আমাদের পুকুরটা আছে। তাতে মাছও আছে প্রচুর। শনিবারে খেলা থাকবে না, সেদিন ছিপ ফেলে মনের আনন্দে মাছ ধরতে পারবে।
এসো ভাই, নইলে আমার মুখরক্ষা হবে না। ইতি :
কৃপানাথ।
পুনশ্চ। বাঙ্গালোরে ফোন করে জানলাম যে, তুমি এখন কলকাতায়।
কাঁকুরগাছির ফ্ল্যাটের ঠিকানা তাঁরাই দিয়েছেন।–কৃপা
চিঠিখানা জোরে-জোরে পড়ে শোনাতে হল, যাতে সবাই শুনতে পান। পড়া শেষ হয়ে যাবার পরে সদানন্দবাবু বললেন, “আজ হল গে রোববার, ৬ এপ্রিল। তার মানে শুক্রবার হল ১১ এপ্রিল। তিনটে দিন… মানে এগারো, বারো আর তেরোই এপ্রিল শক্তিগড়ে কাটিয়ে চোদ্দো তারিখ সোমবার সকালে কলকাতায় ফিরে আপিস করা যাচ্চে। মন্দ কী!”
কৌশিক বলল, “আপনি তো রিটায়ার্ড ম্যান বোস-জেই, আপনার আবার আপিস কিসের?”
“আরে বাবা, আমি কি আর আমার কতা ভাবছিলুম?”
আমি বললুম, “সম্ভবত আমার কথা ভাবছিলেন। কিন্তু নেমন্তন্নটা তো আপনারও নয়, আমারও নয়, ভাদুড়িমশাইয়ের। আপনার-আমার যাবার কথা অতএব উঠছেই না।”
“আরে না না, আমি একা যাব কেন?” ভাদুড়িমশাই বললেন, “যদি যাই তো সবাই মিলেই যাওয়া হবে। কী রে কৌশিক, যাবি?”
“অসম্ভব।” কৌশিক বলল, “টিকিট কাটা হয়ে গেছে, রিজার্ভেশন কনফার্ড, বুধবারে আমি বাঙ্গালোরে ফিরছি। আমার যাওয়ার কোনও কথাই উঠছে না।”
“কিরণবাবু, আপনি?”
“গেলে তো ভালই হয়।” আমি বললুম, “দিব্যি একটা আউটিং হয়ে যায়। ফাইভ-ডে উইকের শনি আর রবি তো ছুটি, বাকি রইল শুক্রবার। ও একটা দিন ক্যাজুয়াল নিয়ে নেব।”
“সদানন্দবাবু?”
“আমি তো যাবার জন্যে এক পা তুলে রেডি হয়েই আছি।” সদানন্দবাবু বললেন, “তা যাব কিসে? হাওড়া থেকে লোকাল ট্রেনে, না বাড়ি থেকে টানা মোটরগাড়িতে?”