বললুম, “আপনার বন্ধু?”
“ছেলেবেলার… মানে সেই যখন কলেজে পড়তুম তখনকার বন্ধু। ভাদুড়িমশাই বললেন, “আই এসসির দুটো বছর একসঙ্গে পড়েছি। আই এসসি পাস করে ও গিয়ে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়। কিন্তু কলেজ আলাদা হলে কী হবে, কলেজ স্ট্রিটের বসন্ত কেবিন আর মির্জাপুর স্ট্রিটের ফেভারিট কেবিনে তখনও রোজ আড্ডা দিয়েছি। ময়দানে গিয়ে ফুটবল খেলাও দেখেছি একসঙ্গে। তারপরে যা হয় আর কি, ডাক্তারি পাস করে ও চলে গেল শক্তিগড়ে, তারপর পশার একটু জমে উঠতে বর্ধমানে গিয়ে চেম্বার খুলল। বাস্, “আমরা দুজনে দুই কাননের পাখি।”
সদানন্দবাবু বললেন, “দ্যাকাসাক্ষাৎ হয়?”
“কালেভদ্রে। শেষ দেখা হয়েছিল নাইনটিন সিক্সটি সেভেনের অক্টোবরে। ওদের শক্তিগড়ের বাড়িতে সেবারে একটা উইকএন্ড কাটিয়ে আসি।”
একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর বললেন, “আঃ, সে-দুটো দিনের কথা এখনও ভুলিনি। পুকুরে মাছ ধরা হল, চড়ুইভাতি করা হল, গানে গল্পে ছুটির দুটো দিন যে কোথা দিয়ে কেটে গেল, টেরই পেলুম না।”
আবার একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। বুঝলুম, স্মৃতি রোমন্থন করছে। খানিক বাদে একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “কৃপানাথের ছোটভাই বিশ্বনাথের কথা হচ্ছিল না? বিশ্বনাথের খেলা সেবারেই দেখি।”
অরুণ সান্যাল বললেন, “একটু আগে আপনি যা বলছিলেন, তাতে তো মনে হয় দুর্ধর্ষ স্ট্রাইকার ছিলেন। সত্যি?”
“ষোলো আনার উপরে আঠারো আনা সত্যি।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমি একটুও বাড়িয়ে বলিনি অরুণ। উনিশ বছরের ছেলেটা দেখলম চুনির মতন ঝটকা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, আবার শুটিং পাওয়ারও প্রদীপের মতো। তা ছাড়া দরকারমতো নিজের স্পিড যেভাবে বাড়িয়ে কমিয়ে খেলছিল, আসলে সেটাই চিনিয়ে দিচ্ছিল ওর জাত। বুঝতে পারছিলাম যে, ফুটবলটা ওর রক্তের মধ্যে রয়েছে।”
কৌশিক দেখলুম মুখ টিপে হাসছে। বললুম, “হাসছ যে? বড়মামার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি?”
“না না, বিশ্বাস হবে না কেন?” কৌশিক বলল, “তবে কিনা আমি একটা অন্য কথা ভাবছিলুম। মানে একটু আগেই বোস-জেঠুর কাছে আমরা নসিপুরের হালা বাঁড়ুজ্যের গপ্পো শুনেছি তো, তাই ভাবছিলুম যে, শক্তিগড়ের বিশ্বনাথ দত্তও কি সেই গোত্রের খেলোয়াড়।”
শুনে সদানন্দবাবু হাঁ করে ঝাড়া এক মিনিট কৌশিকের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, “সেই গোত্রের মানে?”
“মানে হালা বাঁড়ুজ্যে তো আর নিজে খেলতেন না, ভূতেরা তাঁর হয়ে খেলে যেত। তা শক্তিগড়ের বিশ্বনাথ দত্তের হয়েও কি তেনারাই খেলতেন নাকি?”
কৌশিকের কথা শুনে ভাদুড়িমশাই হোহো করে হেসে উঠলেন। তারপর হাসি থামিয়ে বললেন, “না রে কৌশিক, আমি একটুও বাড়িয়ে বলছি না। বুঝতে পারছি, চুনি আর প্রদীপের সঙ্গে তুলনা টেনেছি বলে তুই চটে গেছিস, কিন্তু যেমন চুনি তেমনি প্রদীপকেও তো আমি ভালই চিনি, তাই হলফ করে বলতে পারি যে, বিশ্বনাথের খেলা দেখলে ওরা কিন্তু একটুও চটত না, বরং মফসল থেকে ছেলেটাকে যাতে কলকাতার ময়দানে নিয়ে আসা যায় তার চেষ্টা করত।”
কৌশিক বলল, “সে-চেষ্টা কেউ কখনও করেনি?”
“করেছে বই কী।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কৃপানাথের কাছে শুনেছি, কলকাতার অন্তত একটা বড় ক্লাব ওকে এখানে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছিল।”
“মোহনবাগান?’
“ওই তো তোদের মুশকিল, বড় ক্লাব বলতে তোরা আজকাল শুধু মোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গলকেই চিনিস। কিন্তু এ হল ত্রিশ বছর আগেকার কথা। তখন ফুটবলের মাঠে ইস্টার্ন রেলেরও দাপট নেহাত কম ছিল না। প্রদীপ মানে পি কে বরাবর কোথায় খেলত জানিস? মোহনবাগানেও না,ইস্টবেঙ্গলেও না, ওইইস্টার্ন রেলে। তোইস্টার্ন রেলেরই এক কর্তা—যদুর মনে পড়ছে, কে দাশ-ওকে চাকরি দিয়ে কলকাতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কেন যে বিশ্বনাথের কলকাতায় আসা হল না, তাও তো একটু আগেই বলেছি। আসলে কৃপানাথের বাবাই তার এই ছোট ছেলেটিকে কলকাতায় আসতে দিলেন না।”
অরুণ সান্যাল বললেন, “সে একপক্ষে ভালই হয়েছে। ময়দানের নানা নোংরামির খবর আজকাল কাগজে খুব বড়বড় টাইপে ছাপা হচ্ছে। কিন্তু ভাবের ঘরে চুরি করে তো কোনও লাভ নেই, নোংরামিটা নেহাত গত দু-চার বছরের ব্যাপার নয়, ওটা আগেও অল্পবিস্তর ছিল। যেমন এখন রয়েছে, তেমনি সেভেন্টিজেও ছিল। বিশ্বনাথ দত্ত তখন যদি কলকাতায় খেলতে আসনে তো সেই নোংরা কাদার একটু-আধটু ছিটে কি আর তারও গায়ে লাগত না?”
আমি বললাম, “অরুণ, তুমি ভুল বলোনি। তবে কিনা নোংরামি তখনও ছিল বটে, কিন্তু আজকের মতন এতটা ছিল না। তা ছাড়া নোংরামির চরিত্রও যে ইতিমধ্যে পালটেছে, সেটাও খেয়াল করো। স্পিড আর স্ট্যামিনা বাড়াবার জন্যে খেলোয়াড়রা ওই যে কী সব গোলমেলে ট্যাবলেট খেয়ে মাঠে নামছে বলে শুনতে পাই, এরকম কথা কি আগে কখনও শোনা যেত?”
অরুণ সান্যাল বললেন, “কিন্তু ও-সব যারা খায়, খানিকক্ষণের জন্যে আর্টিফিশিয়ালি ওতে করে কিছুটা সুবিধে হয় ঠিকই, কিন্তু আলটিমেটলি তো স্বাস্থ্যের একেবারে বারোটা বেজে যায়, কিরণদা। আর তা ছাড়া ড্রাগ-অ্যাডিক্ট হয়ে পড়ারও তো একটা ভয় রয়েছে। বঁড়শিতে একবার আটকে গেলেই তো সর্বনাশ!”
“সে তো ঠিকই,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “মারাদোনার যা হয়েছিল আর কী। অত বড় খেলোয়াড়, কিন্তু ওয়ার্ড কাপে ইউরিন টেস্টে ধরা পড়ল যে, ডোপ করে মাঠে নেমেছে। তখন তো বেইজ্জতির একশেষ!”