ভাদুড়িমাশাই হেসে বললেন, “এসে যাবে, এসে যাবে। তার আগে গপ্পোটা শেষ করুন তো। সেমিফাইনালের দিন কে তা হলে মাঠে নেমেছিল?”
“তা যদি বলতে পারতুম, তবে তো ল্যাটা চুকেই যেত। কিন্তু বলতে পারছি কোতায়?”
অরুণ সান্যাল সেই একই কথার পুনরুক্তি করলেন, “তার মানে?”
কাজের মেয়েটি দ্বিতীয় রাউন্ডের চা দিয়ে গেল। ট্রে থেকে লিকারের কাপটা তুলে নিয়ে তাতে আলতো করে ঠোঁট ঠেকিয়ে সদানন্দবাবু বললেন, “বলচি, বলছি। সেমিফাইনালেই হাবলার দাপট দেখে আমাদের সাঁতরা মশাই তক্ষুনি-তক্ষুনি ঠিক করে ফেলেছিলেন যে, ফাইনালের খেলাতেও একে চাই। খেলা শেষ হয়ে যেতেই তাই গাঁট থেকে আরও পঞ্চাশ টাকা বার করে হাবলার দিকে এগিয়ে ধরে তিনি বললেন, ‘ফাইনালের জন্যে এই টাকাটা দিয়ে তোমাকে বুক করে রাকলুম। জেতাতে পারো তো
আরও পাঁচশ টাকা দোব। কিন্তু তাতে কী হল জানেন?”
“কী হল?”
“হাবলা বাঁড়ুজ্যে বলল, নিজের হাতে তো আমি টাকা নিই না। কাল সকালে বরং এই টাকাটা আপনারা আমার মায়ের হাতে দিয়ে আসবেন। বাস, তারপর আর একটাও কতা না বলে হাবলা তার সাইকেলে উঠে চলে গেল।”
“পরদিন সকালে আপনারা তা হলে ফের নসিপুরে গেলেন?”
“তা গেসলম বই কী। গিয়ে দেকি হালার মা শুকনো মুকে বারান্দায় বসে আছেন। আমরা তাকে কিছু বলারও সুযোগ পেলুম না। তার আগেই তিনি তার আঁচলের গিট খুলে দশ টাকার পাঁচখানা নোট বার করে বললেন, ‘কিছু মনে কোরো না বাবারা, পরশু রাত্তির থেকেই আমার ছেলের ধুম জ্বর, তাই তোমাদের হয়ে কাল খেলতে যেতে পারেনি। যে টাকাটা দিয়ে গেলে, সেটা ফিরিয়ে নে যাও, বাবা। শুনে তো আমাদের চক্ষু চড়কগাছ! হাবলা বাঁড়ুজ্যে কাল তা হলে সেমিফাইনালের খেলায় নামেনি? একেবারে তার মতন দেকতে যে-লোকটা কাল সাত-সাতটা গোল দিল, তাও হাফটাইমের আগেই, সে তা হলে কে?”
কৌশিক তার বাপের বকুনি খেয়ে চুপ করে ছিল। কিন্তু কতক্ষণ আর মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকবে। বলল, “যাচ্চলে, হচ্ছিল ফুটবলের গল্প, তো দুম করে সেটাকে আপনি ভূতের লাইনে ঠেলে দিলেন! এটা কী রকমের ব্যাপার হল বোস-জেই?”
সদানন্দবাবু বললেন, “এতে এত আশ্চজ্জি হবার কী আছে? ভূতেদের কি ফুটবল খেলার শখ হয় না? নরমুণ্ড দিয়ে গেণ্ডুয়া খেলার ব্যাপারটা তা হলে এল কোথথেকে? ওহে বাপধন, আমাদের ময়দানে যারা বল পেটায়, তাদের সবাই যে তোমার-আমার মতন জেনুইন মানুষ, তা কিন্তু ভেবো না। অচেন, ওই ভিড়ের মধ্যে তেনারাও দু’চারজন আচেন।”
কথাটা আর এগোল না, কেন না এই সময়েই কলিং বেল বেজে উঠল। তার মিনিট খানেক বাদেই কাজের মেয়েটি এসে জানাল, এক ভদ্রলোক দেখা করতে চান। “বললেন যে, শক্তিগড় থেকে এয়েচেন।”
নাম বললেন না?” প্রশ্নটা অরুণ সান্যালের।
“বললেন তো। তবে সে আমি বলতে পারবনি।”
.
॥ ২॥
পার্বতী, মানে এ-বাড়ির কাজের মেয়েটি বলেছিল, ভদ্রলোক। ফলে আমি ধরে নিয়েছিলুম যে, দর্শনপ্রার্থী ব্যক্তিটি নিশ্চয় একজন বয়স্ক মানুষ হবেন। কিন্তু অরুণ সান্যাল তাকে ভিতরে পাঠিয়ে দিতে বলার একটু বাদে ডান হাতে একটা বড় সাইজের মাটির হাঁড়ি ঝুলিয়ে যে-ছেলেটি এসে ড্রয়িংরুমে ঢুকল, তার বয়স বোধহয় বছর কুড়ির বেশি হবে না। পরনে চকোলেট রঙের ট্রাউজার্স আর সাদা হাফহাতা শার্ট, পায়ে কাবুলি চপ্পল, হাইট প্রায় ছ’ ফুট, চোখ দুটি ঝকঝকে, চাউনি দেখে বেশ বুদ্ধিমান বলে মনে হয়। হাতের হড়িটি আলগোছে মেঝের উপরে নামিয়ে রেখে, শার্টের বুকপকেট থেকে একটা খাম বার করে আমাদের উপরে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে ছেলেটি জিজ্ঞেস করল, “আপনাদের মধ্যে মিঃ ভাদুড়ি কার নাম?”
কোনও ব্যাপারে সন্দেহ বা ভয়ের কারণ ঘটলে সদানন্দবাবু সাধারণত যা করে থাকেন, এক্ষেত্রেও একটু আগে ঠিক তা-ই করেছিলেন। সম্ভবত তার ধারণা হয়েছিল যে, হাঁড়ির মধ্যে সাপ কিংবা কাকড়া বিছে থাকা কিছু বিচিত্র নয়। ফলে, মেঝের উপরে ছেলেটি হাঁড়ি নামিয়ে রাখার সঙ্গে-সঙ্গেই সদানন্দবাবু মেঝে থেকে সড়াক করে তার পা দু’টি সোফার উপরে টেনে নিয়ে একেবারে জোড়াসন হয়ে বসে পড়েছিলেন। সেই অবস্থায় আঙুল তুলে ভাদুড়িমশাইকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন, “উনি।”
হাতের খামখানা ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে ছেলেটি বলল, “আমার নাম ভূতনাথ দত্ত। শক্তিগড়ের ডাক্তার কৃপানাথ দত্ত আমার জ্যাঠামশাই। তিনি এই চিঠিখানা আপনাকে পাঠিয়েছেন।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “বোসো।” তারপর খাম থেকে চিঠি বাব করে চটপট তার উপরে চোখ বুলিয়ে নিয়ে চিঠিখানাকে সেন্টার টেবিলের উপরে রেখে তার উপরে একটা পেপারওয়েট চাপা দিয়ে মৃদু হেসে বললেন, “কৃপানাথ কেমন আছে?”
“এখন ভালই আছেন।’ ছেলেটি বলল, “মাঝখানে জন্ডিস হয়ে মাস দুয়েক খুব ভুগলেন। ভীষণ দুর্বল হয়ে গেলেন। তারপর একটু থেমে থেকে বলল, “বললুম বটে এখন ভাল আছে, তবে দুর্বলতা এখনও পুরোপুরি কাটেনি। নয়তো তিনি নিজেই আসতে।…আপনি যাবেন তো? আমরা কিন্তু সবাই খুব আশা করে আছি।”
যাবার প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “কৃপানাথ তো তোমার জ্যাঠামশাই। তা তুমি ওর কোন ভাইয়ের ছেলে?”
“ছোট ভাইয়ের।”
“তার মানে বিশ্বনাথের। বিশ্বনাথ যে ফুটবলটা দারুণ খেলত, তা নিশ্চয় জানো?”