কৌশিক কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু সদানন্দবাবুর শেষ কথাটায় একটা রোমাঞ্চকর গল্পের গন্ধ পেয়ে যাওয়ায় অরুণ সান্যাল তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “আঃ, তুই দেখছি বকরবকর করেই সক্কলের মাথা ধরিয়ে দিবি। একটু চুপ কর তো। …নিন বোদা, কী ঘটেছিল বলুন।”
আজ রবিবার, ৬ এপ্রিল। কৌশিককে সঙ্গে নিয়ে ভাদুড়িমশাই গত শুক্রবার কলকাতায় এসেছেন। কৌশিক বুধবার বাঙ্গালোরে ফিরে যাবে, কিন্তু ভাদুড়িমশাই তাঁর সি বি আই অর্থাৎ চারু ভাদুড়ি ইনভেস্টিগেশনসের একটা আপিস যেহেতু এখানেও খুলতে চান, তাই পুরো মাসটাই তার কলকাতায় কাটাবার সম্ভবনা। কথা শুরু হয়েছিল এই আপিস ভোলার ব্যাপার নিয়েই। শুনলুম ক্যামাক স্ট্রিটে একটা আপিস বাড়ির দোতলায় বেশ খানিকটা ফ্লোর স্পেস পেয়েও গেছেন। তাতে পাটিশানের ব্যবস্থা করে দিব্যি তিনটে ঘর আর একটা অ্যাটাচড বাথ করে নেওয়া যাবে। চেনা একজন কন্ট্রাকটরের সঙ্গে তা-ই নিয়ে কথাও হয়ে গেছে তার। এখন একজন রিসেপশনিস্ট কাম টাইপিস্ট আর মোটামুটি কাজ জানা দু’জন লোক পেয়ে গেলেই হয়।
গত বছর এই সময়ে ভাদুড়িমশাইয়ের সঙ্গে দিন কয়েকের জন্যে একটা তদন্তের কাজে ইউ পি-র মির্জাপুরে যেতে হয়েছিল। তার পরে আর কোথাও যাওয়া হয়নি। শিগগির যে যাওয়া হবে, এমনও মনে হয় না। একে ভাদুড়িমশাইয়ের শরীর ইদানীং বিশেষ ভাল যাচ্ছে না, তার উপরে আবার এই নতুন আপিস নিয়ে বেশ কিছুদিন তাঁকে এখন ব্যস্ত থাকতে হবে। তাতে অবশ্য আমাদের বেজার হবার কিছু নেই। বরং আপাতত যে তিনি এখান থেকে নোঙর তুলবেন না, তাতেই আমরা খুশি।
কথাবার্তা দিব্যি এগোচ্ছিল। ইতিমধ্যে একগাদা খবরের কাগজ এসে যাওয়ায় সবাই তার উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ভাদুড়িমশাই ইস্টার্ন কুরিয়ারের ফাস্ট পেজের হেডলাইনগুলো দেখে নিয়ে ভিতরের পাতা খুলে জাম্বলের সমাধান করতে লেগে যান। সেন্টারে যুক্তফ্রন্ট থেকে কংগ্রেসের সমর্থন প্রত্যাহারের ফলে দেশের রাজনীতি এবার কোন দিকে মোড় নেবে, তা-ই নিয়ে অরুণ সান্যাল, কৌশিক, সদানন্দবাবু ও আমার মধ্যে আলোচনা চলতে থাকে। অরুণ সান্যাল তাতে বিশেষ উৎসাহ না পেয়ে খানিক বাদে একটা মেডিক্যাল জার্নাল টেনে নেন। কৌশিক ‘ধুর, রাজনীতি আবার ভদ্দরলোক করে!’ বলে খেলার পাতায় চলে যায়। আর তার পরে-পরেই তোলে সাংবাদিকদের কাণ্ডজ্ঞান নিয়ে সেই প্রশ্ন, যার উল্লেখ এই লেখার একেবারে গোড়াতেই করেছি।
অরুণ সান্যাল বললেন, “কী বোদা, চুপ করে আছেন কেন, গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো কী হয়েছিল, বলুন, এইভাবে দগ্ধে মারবেন না তো।”
মালতী রান্নার কাজে ব্যস্ত। তাই পার্বতী, মানে কাজের মেয়েটিকে দিয়ে ইতিমধ্যে সে এক প্লেট পকোড়া পাঠিয়ে দিয়েছিল। সদানন্দবাবু প্লেট থেকে আলগোছে একটি পকোড়া তুলে নিয়ে মুখের মধ্যে চালান করে বললেন, “ওরে ভাই, সে এক ভয়ংকর ব্যাপার! ওই যে খেলার কথা বললুম না, তার এক হপ্তা বাদেই কামারকুণ্ডুর যজ্ঞেশ্বর শিল্ডের সেমিফাইনালে আমাদের সিঙুরের টিম নাবাতে হবে এগেস্ট গুপ্তিপাড়া বুলেটুস। তো হাবলার সেদিনকার খেলা দেখেই আমাদের সিঙুর অ্যাথলেটিক ক্লাবের সেক্রেটারি রতনমণি সাঁতরা বললেন, ‘কোনো কতা নয়, এই নাও পঞ্চাশটা টাকা, এ আমি নিজের গাঁট থেকে দিচ্চি, এই টাকা নিয়ে কাল সকালেই নসিপুরে গিয়ে হালা বাঁড়ুজ্যেকে হায়ার করে ফ্যালো, নয়তো গুপ্তিপাড়ার যা মারকাটারি টিম, সেমিফাইনালে তারা আমাদের কাদিয়ে ছাড়বে। তো তা-ই হল।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা-ই হল মানে গুপ্তিপাড়া আপনাদের কাঁদিয়ে ছাড়ল?”
“আরে না মশাই, তা-ই হল মানে হাবলাকে আমরা হায়ার করে ফেললুম। আর সেমিফাইনালের খেলায় কোতায় গুপ্তিপাড়া আমাদের কাঁদিয়ে ছাড়বে, তা নয়, হাফ-টাইমের আগেই সাত-সাতটা গোল খেয়ে তারাই হাপুস নয়নে কাঁদতে লাগল। তাদের ক্যাপ্টেন এসে বলল, “মশাই, ম্যাচটা আমরা সারেন্ডার করে দিচ্চি। হালার সেভেন্থ গোলটা আটকাতে গিয়ে আমাদের গোলকিপারের পাজরার একখানা হাড় বোধহয় ভেঙে গেচে, রাইট আউট ন্যাংচাচ্চে, লেফট ব্যাকেরও কিছু একটা হয়েছে নিশ্চই, নয়তো ও ওরকম নেতিয়ে পড়ে কাতরাত না! এবারে আমাদের ভালয়-ভালয় বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করে দিন। বাস, ড্যাংডেঙিয়ে আমরা ফাইনালে উঠে গেলুম।”
অরুণ সান্যাল বললেন, “তারপর ফাইনালে ক’ গোলে জিতলেন?”
সদানন্দবাবু নিমপাতা-চিবোনো মুখ করে বললেন, “জিতলুম কোতায়, হেরে ভূত হয়ে গেলুম বাঁশবেড়ের হংসেশ্বরী স্পোর্টিং ক্লাবের কাছে। সেমিফাইনালে সাত গোলে জিতেছিলুম, তাও আদ্ধেক খেলা বাকি থাকতেই, আর ফাইনালে খেয়ে গেলুম আট গোল। কামারকুণ্ডুর স্পেক্টেটররা একেবারে ছ্যা ছ্যা করতে লাগল।”
“তার মানে হাবলা বাঁড়ুজ্যেকে আপনারা ফাইনাল খেলার দিন মাঠে নামাতে পারেননি?”
‘না মশাই, পারিনি।” সদানন্দবাবু বললেন, “অবিশ্যি সেমিফাইনালের দিনও যে তিনিই মাঠে নেমেছিলেন, তাও বলতে পারছি না।”
“তার মানে?”
প্লেট থেকে আর-একটা পকোড়া তুলে মুখের মধ্যে ফেলে দিয়ে সদানন্দবাবু বললেন, “বেড়ে করেছে কিন্তু। সকালে আমার সেকেন্ড কাপ খাওয়া হয়ে গেছে ঠিকই, তবে কিনা এর সঙ্গে আর-এক কাপ চা হলে মন্দ হত না।”