“করুন।”
“এঁয়ারা কারা?”
“যাব্বাবা,” হতভম্ব হয়ে কৌশিক বলল, “এরা কারা, আপনি জানেন না? এঁরা হচ্ছেন সেই তারা, ফুটবলে যাদের অল-টাইম গ্রেট বলা হয়। কেন, টিভিতে আপনি মারাদোনার খেলা দেখেননি?”
সানন্দবাবুর মুখ দেখে মনে হল না যে, কৌশিকের কথা শুনে তিনি বিন্দুমাত্র দমে গিয়েছেন। একই রকমের গম্ভীর গলায় বললেন, “না হে, দেকিনি। কিন্তু তাতে হলটা কী?”
কৌশিক হেসে বলল, “কী আর হবে, একজন জিনিয়াস কীভাবে ফুটবলটাকে নিয়ে যা-খুশি তা-ই করতে পারে, সেটা দেখতে পাননি, এই আর কী।”
“বটে? তা ফুটবল নিয়ে যা-খুশি তা-ই কি একা ওই লোকটাই করতে পারত?”
“আর-কেউ পারত…মানে পেলের পরে এক ওই মারাদোনা ছাড়া আর কেউ পারত বলে তো জানি না।” ঠাট্টার গলায় কৌশিক বলল, “কেন, আপনি কি জানেন নাকি?”
সদানন্দবাবু তক্ষুনি এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না। চা এসে গিয়েছিল। নিজের পেয়ালায় আলতো একটা চুমুক দিয়ে পেয়ালাটাকে ধীরেসুস্থে পিরিচের উপর নামিয়ে রেখে তিনি কৌশিকের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, “হাবল। বাঁড়ুজ্যের খেলা দেকেচ?”
এবারে কৌশিকেরই ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার পালা। আমতা-আমতা করে বলল, “না
“কী করেই বা দেকবে।” ঠোঁট বেঁকিয়ে সদানন্দবাবু বললেন, “তোমার তো কতাই ওটে না, তোমার বাবাও তখনও জন্মাননি।”
অরুণ সান্যাল বললেন, “অ্যাঁ, বলেন কী! তিনি কবেকার মানুষ?”
“ফাস্ট ওয়ার্লড ওয়ার তো ১৯১৪ সালে লাগে, তিনি তারও বারো বছর আগে, অর্থাৎ নাইনটিন হানড্রেড টু’তে জন্মেছিলেন। ছেলেবেলায় আমরা তার খেলা দেকিচি। উঃ, সে কী খেলা রে বাবা, হরিচরণ মেমোরিয়াল শিল্ডের খেলায় উঁচড়ো ইউনাইটেডকে একাই এক ডজন গোল দিয়েছিলেন।”
কৌশিক বলল, “কলকাতায় খেলতেন?”
“আমাদের ময়দানের কতা বলছ তো? মাত্তর একবারই এখেনে খেলতে নেবেছিলেন। এ হল নাইনটিন টুয়েন্টির কতা। গোরা টিমের সঙ্গে ফ্রেন্ডলি ম্যাচ। সায়েবগুলোকে তাতেই এমন কঁদিয়ে ছাড়েন যে, সেই রাত্তিরেই গলির ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে তারা একজন মেসেঞ্জার পাটিয়ে দেয়। মেসেঞ্জার গিয়ে হাকিমকে বলে, স্টপ দিস হালা বাঁড়ুজ্যে, ডিফেন্স অব ইন্ডিয়া আইনে ওর মুভমেন্ট রেসট্রিকট করো, ওকে যদি কলকাতায় আসতে দাও, তা হলে এখেনে ল অ্যান্ড অর্ডার মেনটেন করা যাবে না, ব্রিটিশ গবরমেন্টের প্রেস্টিজ ও একেবারে পাংচার করে দেবে। ব্যস, হালা বাঁড়ুজ্যে তার পরদিন তারকেশ্বর লাইনের নসিপুরে তার বাড়িতে ফিরতেই কুম জারি হয়ে গেল যে, হুগলি জেলার চৌহদ্দি ছেড়ে তিনি কোতাও যেতে পারবেন না। তার ফল কী হল, ভাবতে পারো?”
“কী হল?”
“নাইনটিন টুয়েন্টিতেই মোহনবাগান ফর দি সেকেন্ড টাইম আই এফ এ শিল্ড জেতার যে চেষ্টা চালাচ্ছিল, আর তার জন্যে হাবলা বাঁড়ুজ্যেকে টিমে ঢোকাবার ব্যবস্থা একেবারে পাকা করে ফেলেছিল, সেটা আর সাকসেসফুল হল না।”
“এ সব কথা আপনি কার কাছে শুনলেন?”
“কেন, আমার বাবার কাছে।” চায়ের পেয়ালায় শেষ চুমুক দিয়ে সদানন্দবাবু বললেন, “ওহে বাপধন, সারা জীবন সায়েব চরিয়ে খেয়েচি, সায়েব চিনতে আর আমার বাকি নেই। ওদের মদ্যে আমাদের কোম্পানির জেঙ্কি সায়েবের মতো ভাল মানুষ যেমন আচে, তেমনি কুচুটে বজ্জাতও কি কিছু কম আচে নাকি? তা যদি না থাকত, তো মারাদোনার নাম না কপচে তোমরা আজ হাবলা বাঁড়ুজ্যেকে মাথায় তুলে নাচতে।”
ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলুম, তার চোখের মধ্যে ঈষৎ কৌতুকের ছোঁয়া লেগেছে, তবে হাসিটাকে তিনি ঠোঁট পর্যন্ত আসতে দিচ্ছেন না। বললেন, “একটু আগে বলছিলেন যে, ছেলেবেলায় আপনি তার খেলা দেখেছেন। এটা কোথায় দেখলেন?”
“সিঙুরে।” সদানন্দবাবু বললেন, “তারকেশ্বর বলতে যে জায়গাটা আপনারা বোজেন, আমরা তো ঠিক সেখেনকার লোক নই। ওর খুব কাঁচেই হচ্ছে সিঙুর। আমরা সেই সিঙুরের বাসিন্দা। সেখানকার মাঠে হাবলা বাঁড়ুজ্যের খেলা আমি ফর দি ফাস্ট টাইম দেকি। আমার বয়স তখন আব কত হবে, মেরেকেটে পাঁচ কি ছয়। সেদিনকার খেলার ডিটেলস আমার মনে নেই, তবে এটা ভুলিনি যে, হাফটাইমের আগেই একটা লোক দমাদ্দম চার-পাঁচটা গোল হাঁকড়ে দিয়েছিল। পরে শুনলুম, সে-ই হচ্চে হাবলা বাঁড়ুজ্যে।”
“দ্বিতীয়বার তাঁর খেলা কবে দেখলেন?”
“ইন দি ইয়ার নাইনটিন ফফটি টু।” সদানন্দবাবু বললেন, “জাপানিরা হাতিবাগানে বোমা ফেলেছিল বলে আমরা সেবার কলকাতার পাট তুলে দিয়ে মাস ছয়েকের জন্যে আমাদের গ্রামের বাড়িতে চলে যাই।”
“নাইনটিন ফর্টি টু?“ ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপনারই হিসেবে হাবলা বাঁড়ুজ্যের বয়েস তো তখন চল্লিশ হয়ে গেছে!”
“তা তো হয়েইছে। কিন্তু এই বুড়ো হাড়েই যা ভেলকি দেকালেন না…উফ!” সদানন্দবাবু দু’ হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বললেন, “অপূর্ব, অপূর্ব! সেই খেলাতেই তো চুচড়ো ইউনাইটেডকে গুনে-গুনে এক ডজন গোল দেন! কী বলব মশাই, খেলাটা যেন এখনও আমার চোকের সামনে ভাসচে! ইদিকে হাল্লা, ওদিকে হালা, সিদিকে হাল্লা…যেদিকে তাকাই, শুধু হাল্লা আর হাল্লা! গোটা মাঠে তাকে ছাড়া কাউকে দেতে পাই না! ভাবা যায়?”
একটুক্ষণের জন্য চুপ করলেন সদানন্দবাবু। তারপর একটু গলা নামিয়ে বললেন, “কিন্তু তার এক হপ্তা বাদেই ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা! উঃ, সেকতা ভাবলে এখনও গায়ে কঁটা দেয়।”