শুনে সদানন্দবাবু বললেন, “তা তো হল, কিন্তু চোরগুলো ধরা পড়বে তো?”
“পড়বে বলেই তো আশা করছি,” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “তবে কিনা চুরিটা যে বন্ধ হবে, আপাতত সেটাই বড় কথা। অবিশ্যি আমার রিপোর্ট অনুযায়ী যদি কাজ
কথাটা শুনে সদানন্দবাবু যে খুব খুশি হয়েছেন, তা মনে হল না। বেজার গলায় বললেন, “আমি হলে কিন্তু ফাস্ট অব অ ওই চোরগুলোকেই ধরে ফেলতুম মশাই।”
অরুণ সান্যাল বললেন, “কী করে ধরতেন?”
এই প্রসঙ্গেই এসেছিল বাটি চালানের কথা। সদানন্দবাবু হেসে বলেছিলেন, “সেটা তো অতি সহজ কাজ, মশাই। স্রেফ বেন্দাবন মাঝিকে ডাকিয়ে এনে বলতুম, বাটি চালাও!”
অরুণ সান্যাল গল্পের গন্ধ পেয়ে গিয়েছিলেন। অপ্রাকৃতে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস না থাকা সত্ত্বেও মুখেচোখে নকল কৌতূহল ফুটিয়ে বললেন, “বেন্দাবন মাঝি? হু ইজ হি? আ বোটম্যান?”
কৌশিক বলল, “অ্যান্ড হোয়াট ডাজ হি ডু উইথ আ বাটি?”
“বেন্দাবন ইজ অ্যান ওঝা।” সদানন্দবাবু গম্ভীর গলায় বললেন, “আর ওই বাটি হচ্চে তার ওয়েপন। তার বাটি চালানের ওস্তাদি তত আপনারা দ্যাকেননি। দেকলে আর মশকরা করতে হত না, সব্বাই থ মেরে যেতেন। ওরে বাবা রে বাবা, সে তো হুলুস্থুল কাণ্ড মশাই!”
বাস, শুরু হয়ে গেল বাটি চালানের গল্প। যে-গল্পের আদ্যন্ত আমরা একটু আগেই শুনেছি।
তা গল্প এক সময়ে শেষ হল। দু’চারটে কথাও হল তা-ই নিয়ে। অরুণ সান্যাল আর ভাদুড়িমশাই এমন দু’চারটে খোঁচা-মারা মন্তব্য করলেন, যাতে বোঝা গেল যে, বেন্দাবন মাঝির ভয়াবহ সব কীর্তিকলাপের একটি বর্ণও তারা বিশ্বাস করেননি। কৌশিক অবশ্য তার বাপ কিংবা মামার মতো গল্পটাকে একেবারে তুড়ি মেরে উড়িয়ে না দিয়ে বলল, “কী জানি বাবা, হতেও পারে।”
সদানন্দবাবু তাতে আরও রেগে গিয়ে বললেন, “হতে পারে কী হে, হয়েছিল। বলো তত বেন্দাবনকে ডেকে পাটাই, সে এসে নিজের মুকে সব বলুক। তা হলে তো বিশ্বেস হবে?”
কৌশিক এর উত্তরে কী বলত, তা আর শোনা হল না, কেন না সেই মুহূর্তে ফ্ল্যাটের কলিং বেল বেজে উঠল, আর তার একটু বাদে এ বাড়ির কাজের মেয়েটি এসে বলল, “একজন বাবু এয়েছেন, মামাবাবুর সঙ্গে দ্যাক করতে চান।”
.
॥ ২॥
কাজের মেয়েটি যে-ভদ্রলোকটিকে সঙ্গে করে ড্রয়িং রুমে পৌঁছে দিয়ে গেল, পঞ্চাশ থেকে পঁচাত্তরের মধ্যে যে-কোনও বয়সই তার হতে পারে। এই রকমের চেহারা আকছার চোখে পড়ে না, এইরকমের পোশাকও না। মানুষটি লম্বা প্রায় ফুট ছয়েক। শরীর অতিশয় কৃশ ও দড়ি-পাকানো টাইপের। মাথার সামনের দিকের চুল উঠে যাওয়ায় খুলির অনেকখানি অংশ কপালের দখলে এসে গেছে। মাথার বাদবাকি অংশের চুলের গোড়ার দিকটা সাদা, উপরের দিকটা লালচে। তাতে মনে হয়, ভদ্রলোক কলপ ব্যবহার করতেন, কিন্তু, যে-কোনও কারণেই হোক, এখন আর করেন না। গালের হাড় উঁচু। রং ফর্সা, কিন্তু ফ্যাকাশে। খাড়া নাকের নীচে পাকানো গোঁফ। গোঁফের দুই প্রান্তদেশ ছুঁচোলো ও ঊর্ধ্বমুখী। দৃষ্টিপাতের ধরনে কিছুটা সন্দেহের সঙ্গে খানিকটা আত্মম্ভরিতাও মিশে আছে। অক্ষিতারকা নীলবর্ণ, কিন্তু কিঞ্চিৎ ঘোলাটে। চোখের কোলে যে-পরিমাণ কালি জমেছে, তাতে রাত্রি-জাগরণের ছাপ স্পষ্ট। একই সঙ্গে সন্দেহ হয় যে, ইনি খুব একটা সুশৃঙ্খল ও নিয়মনিষ্ঠ জীবন যাপন করেন না।
ভদ্রলোকের পায়ে শুড়হোলা লপেটা। পরনে চুনোট করা কচি ধুতি ও ঊর্ধ্বাঙ্গে একটু লম্বা ঝুলের বর্ডার বসানো হালকা গোলাপি রঙের মেরজাই। হাতে রুপোবাঁধানো পাতলা ছড়ি। মেরজাইটিতে বোতাম নেই, সেটি বুকের একপাশে ফিতে দিয়ে বাঁধা। সব মিলিয়ে উনিশ শতকের কাপ্তান বাবু বলে ভ্রম হয়। এমনও সন্দেহ হয় যে, দীনবন্ধু মিত্রের ‘সধবার একাদশী’ কি অমৃতলাল বসুর ‘বিবাহ বিভ্রাট’ নাটকে অভিনয় করতে করতে ইনি রঙ্গালয় থেকে সরাসরি এখানে চলে এসেছেন। কিন্তু তার আগে সাজঘরে ঢুকে পোশাকটা পালটে আসেননি।
বুকের কাছে আড়াআড়ি করে ধরা ডান হাতের কব্জির উপর দিয়ে কোঁচার প্রান্তদেশ ঝুলিয়ে দেওয়া, ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে অরুণ সান্যালের ইঙ্গিত অনুযায়ী সামনের সোফায় বসেই একটা ভুল করে বসলেন। ডান হাতের ছড়ির ডগাটি ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তুলে ধরে বললেন, “কাগজে আপনাব ছবি দেখেছি। আপনি নিশ্চয় মিঃ চারু ভাদুড়ি?”
ভাদুড়িমশাই তক্ষুনি তার প্রশ্নের জবাব দিলেন না। একেবারে স্থির চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর কেটে-কেটে, প্রতিটি শব্দকে পৃথকভাবে উচ্চারণ করে বললেন, “আপনি কি এইভাবেই সকলের সঙ্গে কথা বলেন নাকি?”
ভদ্রলোক যে হকচকিয়ে গেছেন, সেটা তার মুখচোখ দেখেই আমরা বুঝতে পারছিলাম। একটু বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে বার দুয়েক ডাইনে-বাঁয়ে তাকিয়ে বললেন, “আপনার কথাটা ঠিক বুঝতে পারছি না। এইভাবে মানে?”
“এইভাবে মানে যাঁর সঙ্গে কথা বলছেন তার দিকে ছড়ি উঁচিয়ে বলেন?”
ভদ্রলোকের বিভ্রান্ত ভাব তখনও কাটেনি। বললেন, “আজ্ঞে হ্যাঁ, এইভাবেই তো বলি।”
“আর বলবেন না।” ভাদুড়িমশাই ঈষৎ হেসে বললেন, “বাড়িতে চাকরবাকরদের সঙ্গে যদি-বা বলেন, বাড়ির বাইরে কারও সঙ্গে বলবেন না।”
“কেন, এতে দোষ হয়?”
“আমার ধারণা, হয়। আর কথা যখন আমার সঙ্গে, তখন আমার যেটা ধারণা, সেই অনুযায়ী আপনাকে কথা বলতে হবে।….দিন, ছড়িটা আমাকে দিন।”