“চুনি-পি কেবলরামের সময়ে যা খেলতুম, সেই তুলনায় অর্ধেক ভালও খেলছি না; তবে হ্যাঁ, মাঝখানে যে অধঃপতনটা ঘটেছিল, সেটা একটু সামলে নেওয়া গেছে। এবারকার ন্যাশনাল লিগ আর নেহরু কাপের খেলা দেখে অন্তত সেইরকমই মনে হল।”
একটুক্ষণ চুপ করে রইল কৌশিক। তারপর বলল, “কিন্তু মুশকিলটা কী হয়েছে জানো বাবা?”
অরুণ সান্যাল ফুটবল বলে কথা নেই, কোনও খেলারই খবর বিশেষ রাখেন না। মাঠ-ময়দানের ব্যাপার-ট্যাপার নিয়ে আসলে কোনও উৎসাহই নেই তার। তবু ছেলের কথার উত্তরে কিছু একটা না বললে ভাল দেখায় না বলেই আমতা-আমতা করে বললেন, “কেন, আবার কী মুশকিল হল?”
“কী মুশকিল হল, সেটা কিরণমামাকে জিজ্ঞেস করো।” বলে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “এই তোমরা মানে জার্নালিস্টরাই হচ্ছে যত নষ্টের গোড়া। ফুটবলে আমাদের পারফরম্যান্সের গ্রাফের লাইনটা যেই না একটু উপরে উঠতে শুরু করেছে, অমনি তোমরা এমন হই-হই বাধিয়ে দিলে যে, আর দেখতে হবে না, লাইনটা আবার মুখ থুবড়ে পড়ল বলে!”
কথার ঝাঁঝ থেকেই বোঝা যাচ্ছিল কৌশিক বেশ রেগে গেছে। কিন্তু রাগের কারণটা যে কী, সেটাই ঠিক ধরতে পারছিলুম না। ভাদুড়িমশাই, সদানন্দবাবু আর অরুণ সান্যালের মুখ দেখে মনে হল, তারাও কিছুই ধরতে পারেননি। ভাদুড়িমশাই বললেন, “একটু বুঝিয়ে বলবি?”
সদানন্দবাবু বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, একটু বুজিয়ে বলো তো।”
“এর মধ্যে আর বোঝাবুঝির কী আছে?” কৌশিক তার হাতের ‘বিশ্ববার্তা’ কাগজখানা আমার দিকে এগিয়ে ধরে, খেলার পাতার একটা তিন-কলম-জোড়া হেডলাইনের উপরে আঙুল রেখে বলল, “পড়ে দ্যাখো, তা হলেই সব বুঝতে পারবে।”
বিশাল টাইপের বিরাট হেডলাইন, ‘যে গোল দেখলে পেলে আর মারাদোনাও তাজ্জব হয়ে যেত!
সদানন্দবাবু বললেন, “পড়ে শোনান, পড়ে শোনান, আমরাও শুনতে চাই।”
অগত্যা যেমন হেডলাইন তেমন কোচি থেকে পাঠানো প্রতিবেদনও পড়ে শোনাতে হল। বিশ্ববার্তার স্পোর্টস রিপোর্টার ধনঞ্জয় চাকলাদার লিখছেন : “উজবেকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের আই, এম, বিজয়ন যে গোলটি করলেন, তাকে বিশ্বমানের গোল বললেও খুব কমই বলা হয়, কেন না ইউরো কাপ আর কোপা আমেরিকার কোনও খেলাতেই এমন অত্যাশ্চর্য গোল দেখবার সৌভাগ্য আমাদের হয়নি। এমন কী, গত তিন বারের বিশ্বকাপেও না। দুদিকে দুই হুমদো-জোয়ান উজবেক ডিফেন্ডার, ভাল করে ঘুরে দাঁড়াবার জায়গাটুকু না রেখে তারা বিজয়নের গায়ের সঙ্গে একেবারে আঠার মতন সেঁটে রয়েছে, অথচ তারই মধ্যে সামান্য একটু টলে গিয়ে, বলটাকে অল্প তুলে নিয়ে, মুখ না ঘুরিয়েই বিজয়ন যে বাইসিকল কিক করলেন, গোলকিপারের মাথার উপর দিয়ে তাতেই বল গিয়ে জালে জড়িয়ে গেল। এ একেবারে অর্জুনের লক্ষ্যভেদ। দর্শকরা প্রথমে কিছুই বুঝতে পারেননি, তারপরেই তারা উল্লাসে ফেটে পড়েন। উন্নাস স্বাভাবিক, কেন না অনেক ভাগ্য করে জন্মালে তবেই এমন একটি গোল দেখার সুযোগ পাওয়া যায়। সত্যি বলতে কী, পেলে আর মারাদোনাও এই গোল দেখলে তাজ্জব হয়ে যেতেন। তবে আমার ধারণা, ভারতের মাঠে এই ধরনের গোল হয়তো আমরা আর দেখতে পাব না, কেন না বিদেশিরাও বিজয়নের এই খেলা টিভির পর্দায় দেখেছে নিশ্চয়, এবং এই গোলের পরে ব্রিটেনের ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড, স্পেনের রিয়েল মাদ্রিদ, হল্যান্ডের আয়াক্স, ইতালির এ সি মিলান ও আর্জেন্টিনার বোকা জুনিয়র্স থেকে বিজয়নের ডাক পড়তে বাধ্য। আসন্ন, অনিবার্য সেই দিনটিকে আজ আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, এইসব বিশ্ববিখ্যাত ক্লাবের ধনকুবের কর্তারা যখন চেকবই হাতে নিয়ে বিভিন্ন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনের জাম্বো জেট থেকে দিল্লি, কলকাতা, মুম্বই কি চেন্নাই এয়ারপোর্টে এসে নামবেন ও নেমেই কানেকটিং ফ্লাইট ধরে যাত্রা করবেন তিরুবনন্তপুরমের দিকে, এবং…”
.
“থাক্, থাক্, কিরণমামা, আর পড়ার দরকার নেই।” পুরো সেনটেন্সটা কমপ্লিট করার আগেই কৌশিক আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “যেটুকু পড়েছ, তাতেই তোমাদের জার্নালিস্টদের কাণ্ডজ্ঞানের বহরটা টের পাওয়া যাচ্ছে, এর পরে তুমি নিজেই বোধহয় বিষম খেতে শুরু করবে!”
কাগজ থেকে মুখ তুলে দেখলুম, ভাদুড়িমশাই আর অরুণ সান্যাল মুখে রুমাল চাপা দিয়ে হাসির বেগ সামলাচ্ছেন। তারই মধ্যে সদানন্দবাবুকে দেখে একটু অবাক হতে হল। কেন না, একমাত্র তারই মুখে হাসি নেই। গম্ভীর গলায় বললেন, “এতে এত হাসির কী আচে?”
কৌশিক বলল, “নেই? তার মানে আপনিও মনে করেন যে, ভাল একটা গোল করেছে বলেই বিশ্ববিখ্যাত এইসব ক্লাব অমনি বিজয়নকে নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু করে দেবে?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “ডেসক্রিপশান থেকে তো মনে হচ্ছে…মানে অন্য সব কাগজও দেখলুম তো…তাতে তো বলতেই হয় যে, গোলটা সত্যিই চমৎকার দিয়েছে।”
“আহা-হা, আমি কি বলছি যে, ওটা চমৎকার গোল নয়? অফ্ কোর্স ইট ওয়াজ আ ব্রিলিয়ান্ট গোল! কিন্তু তাই বলে যদি কেউ বলে যে, পেলে আর মারাদোনাও এই গোলটা দেখলে তাজ্জব হয়ে যেত, তো আমি বলব তার কাণ্ডজ্ঞান বলতে কিসসু নেই!”
“দ্যাকো কৌশিক, সদানন্দবাবু বললেন, “এর মদ্যে তুমি দু-দুবার পেলে আর মারাদোনার নাম করেছ। তো একটা কতা তোমাকে জিগেস করতে পারি?”