“তারপর এক পুরুষ অর্থাৎ চন্দ্রভূষণকে বাদ দিয়ে আমাদের বিমলভূষণের চোখেও সেই নীল রং এসে ঢুকে পড়েছে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “একে কী বলে জানেন তো? আটাভিজম।”
বলে আর অপেক্ষা করলেন না ভাদুড়িমশাই, দরজার পর্দা সরিয়ে তার ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লেন।
ঘণ্টা দুয়েক গড়িয়ে নিয়ে বিকেলে একবার সবাই মিলে ভদ্রেশ্বরে যাওয়া হয়েছিল। লুই আঁতোয়নের চিঠিখানা হরসুন্দরবাবুকে ফিরিয়ে দিয়ে এসেছি। ভদ্রলোককে বড়ই বিমর্য মনে হল। মানতের চুল আগেভাগেই কেটে দিয়েছেন বলে যেমন পাড়ার পাঁচজনের কাছে তেমন নিজের বাড়িতেই তাকে বোধহয় খুবই হোস্তা হতে হয়েছে।
ভদ্রেশ্বর থেকে একেবারে সরাসরি আমরা চন্দননগরের স্ট্র্যান্ডে চলে যাই। সেখানে গঙ্গার ধারে রাত প্রায় আটটা অব্দি বসে গল্পগুজব করি। একটু আগে পরমেশের বাড়িতে ফিরে স্নান করে রাতের খাওয়া সেরে নিয়েছি। এখন ছাতের উপরে মাদুর বিছিয়ে বসে চলছে আড্ডা।
তারই মধ্যে হঠাৎ ভাদুড়িমশাই বললেন, “একটা ব্যাপার কিন্তু বোঝা গেল না। আজ সকালে মন্দির-চত্বরে ওই যে মেন সুইচ অফ করে আলো নিবিয়ে দেওয়া হয়েছিল, ওটা কে করল?”
সদানন্দবাবু বললেন, “তা জানি না, তবে আলো নিববার আগে কিন্তু একটা লোককে খুবই সন্দেহজনকভাবে আমি ওখানে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছিলুম। লোকটা যেমন বেঁটে, তেমনি কালো। তা ছাড়া তার গালে বেশ বড়সড় একটা আঁচিলও দেখেছি।”
আমি বললাম, “এ তো গৌরাঙ্গ ভটচাজের দেওয়া বর্ণনার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। গঙ্গার ঘাটে গৌরাঙ্গ অবশ্য দু’জন লোককে হিরে নিয়ে কথা বলতে শুনেছিল। অন্যজনও কালো, তবে বেঁটে নয়, ঢ্যাঙা।”
“ঢ্যাঙাটা হয়তো ভিড়ের মধ্যেই ছিল।” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “হয়তো দু’জনে মিলে প্ল্যান এঁটেছিল যে, বেঁটেটা মেন-সুইচ অফ করে দিলেই ঢ্যাঙাটা অমনি অন্ধকারের মধ্যে ছিনিয়ে নেবে হরপার্বতীর চোখ। ইতিমধ্যে আরেকজনও যে হিরে চুরির ধান্ধায় আছে, তা তারা জানত না।….তবে আমার কী মনে হয় জানেন? নুটুর বউ যে হিরে চুরির প্ল্যান এঁটেই মন্দিরে এসেছিল, তা নয়। হঠাৎ একটা সুযোগ এসে যাওয়ায় অন আ সাডেন ইমপালস সে ওটা করেছে। মানে অন্যেরা জমি তৈরি করে দিল, অ্যান্ড শি জাসট রিপড় দ্য হারভেস্ট!”
পরমেশ চৌধুরি বললেন, “একেই বলে চোরের উপর বাটপাড়ি?”
আমরা হেসে উঠলুম।
ভুতুড়ে ফুটবল
ভুতুড়ে ফুটবল – গোয়েন্দা ভাদুড়িমশাই – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
“এ তো বড় অদ্ভুত ব্যাপার, মামাবাবু!” হাতের কাগজ থেকে মুখ না তুলেই কৌশিক বলল, “আমাদের জার্নালিস্টদের কি মাথা খারাপ হয়ে গেল? এদের কি কাণ্ডজ্ঞান বলে। কিছু থাকতে নেই?”
কথাটা ভাদুড়িমশাইয়ের উদ্দেশে বলা হয়েছিল, কিন্তু তিনি কোনও উত্তর দিলেন না। সম্ভবত কিছু শুনতেই পাননি। না-পাওয়াই স্বাভাবিক। কেন না, নিবিষ্টচিত্তে তিনি এখন ইস্টার্ন কুরিয়ার’-এর আজকের ওয়ার্ড-জাম্বলের উত্তর খুঁজছেন।
নিজে যেহেত খবরের কাগজে কাজ করি, তাই কী খবর দেখে জার্নালিস্টদের কাণ্ডজ্ঞান সম্পর্কে কৌশিকের হঠাৎ সন্দেহ দেখা দিল, এই পালটা প্রশ্নটা করতে যাচ্ছিলুম, কিন্তু মুখ খুলবার ফুরসত পেলুম না, সদানন্দবাবু একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়ে বললেন, “ঠিক বলেচ, লাক কতার এক কর্তা বলেচ! আরে ছ্যা ছ্যাঁ, এই কি তোদের কাণ্ডজ্ঞান? দেকতে পাস না চোকের সামনে কী হচ্চে?”
অরুণ সান্যাল একটা সদ্য-আসা মেডিক্যাল জার্নালের পাতা ওলটাচ্ছিলেন। সেটা সরিয়ে রেখে বললেন, “কী হচ্ছে বোসদা?”
“বাঃ, তাও বলে দিতে হবে?” সদানন্দবাবু তার গলার পর্দা আরও এক ধাপ চড়িয়ে বললেন, “শহরটা যে চোর ছ্যাচড়ে আর গুণ্ডা-বদমাসে ভরে গেল, মশাই! আজ এখোনে ফ্ল্যাটে ঢুকে বন্দুক উঁচিয়ে ডাকাতি করছে তো কাল ওভেনে দিন-দুপুরে বোম ফাটিয়ে টাকার থলে কেড়ে নিচ্ছে! আর খবরের কাগজের লোকগুলোও হয়েছে তেমনি। এই যে ল-লেসনেস, কোতায় এর এগেস্টে রোজ একটা করে কড়া এডিটোরিয়েল লিকবি, তা নয়, তোরা আছিস শুদু পলিটিকস নিয়ে! কে কাকে নিকম্মার ধাড়ি বলেচে আর কার বউ। সরকারি বাড়িতে খাটাল বসিয়ে লাখ টাকার দুধ বিক্রি করচে! তা বলুক না, করুক না! নিকম্মাই বলুক আর অকম্মাই বলুক, দুধই বেচুক আর রাবড়িই বেচুক, তাতে তোর কী! খালি পলিটিক্স আর পলিটিকস! ঠিক বলেচ কৌশিক বাবাজি, এই পলিটিক্সই আমাদের ডুবিয়ে ছাড়ল!”
কৌশিক বলল, “যাব্বাবা! আমি মোটেই পলিটিকসের কথা ভাবছি না।”
সদানন্দবাবু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললেন, “পলিটিক্স নয়? তা হলে?”
ভাদুড়িমশাইয়ের জাম্ব মিলে গিয়েছিল। মৃদু গলায় বললেন, “হয়েছে। একটা ‘ই’ পাচ্ছিলুম না। তা উলটে-পালটে ‘সেনল্যাক’ যদি ক্যানসেল হয় তো তার মধ্যেই তো ‘ই’ পেয়ে যাচ্ছি। সব মিলিয়ে ম্যাজিক ওয়র্ডটা তা হলে দাঁড়াল ‘ক্রিকেট’। ও হ্যাঁ, তুই যেন কী বলছিলি কৌশিক?”
“আমি পলিটিক্সের কথাও ভাবছিলুম না, ক্রিকেটের কথাও ভাবছিলুম না। যেখানে মাত্তর একশো কুড়িটা রান দরকার, সেখানে একশো রান তুলতেই যাদের কালঘাম ছুটে যায়, তাদের নিয়ে আবার ভাববার কী আছে?”
অরুণ সান্যাল বললেন, “তা হলে?”
“আমি ভাবছিলুম ফুটবলের কথা।”
“অ্যাঁ, ক্রিকেটের তুলনায় ফুটবলটা কি আমরা ভাল খেলছি নাকি?”