“টাকা তাকে দেবে কে? চন্দ্রভূষণ? তিনি তো চিঠিতে কী আছে, তা জানতেও পারেননি। তার আগেই তিনি জ্বরে পড়েন। মারাও যান সেই জ্বরেই।”
বললুম, “কিন্তু টাকা না-পেয়ে ব্যাপারটাকে লুই আর পার্স করেনি?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “মনে তো হয় না। আমার ধারণা, ধার শোধ করতে না-পারায় লোকটার জেল হয়, আর জেলের মধ্যেই সে মারা যায়। অবশ্য এটা আমার ধারণা মাত্র, ঠিক কী যে হয়েছিল, তা তো জানার উপায় নেই। তবে হ্যাঁ, আর-কোনও চিঠি সে বোধহয় লেখেনি। লিখলে সেকথা বিমলভূষণ নিশ্চয় জানাত।”
“আর ওই মার্ত্যাঁ লুমিয়ের?”
“ও তত নেহাতই একজন রিসার্চ স্কলার। হিন্দু টেম্পল নিয়ে রিসার্চ করতে এসেছে, কাজ শেষ করে দেশে ফিরে যাবে।…না না, চুরি-বাটপাড়ির সঙ্গে ওর কোনও সম্পর্ক নেই।”
আমার সন্দেহ কাটছিল না। বললুম, “কৌশিক ওকে প্রথমবার দেখে বলেছিল, লোকটার চোখ নীল। পরে আমি শ্রীরামপুর পেরিয়ে দেখলুম নীল নয়, বাদামি। এটা কী করে হয়?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “হতেই পারে। কনটাক্ট লেন্স পালটালেই হয়। আজকাল তো ওটাই ফ্যাশন।”
পরমেশ চৌধুরি ইতিমধ্যে বাড়ির ভিতরে গিয়ে চায়ের কথা বলে এসেছিলেন। ভৃত্য এসে সেন্টার টেবিলে চায়ের সরঞ্জাম সাজিয়ে দিয়ে গেল। সদানন্দবাবু নিজের পেয়ালায় লিকার ঢেলে নিলেন। অন্যেরা যিনি যেমন পছন্দ করেন, সেইমতোবানিয়েও দিলেন অন্যদের চা। তারপরে নিজের পেয়ালায় একটা চুমুক দিয়ে বললেন, “একটা কব্জিজ্ঞেসকরব?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “মাত্র একটা কেন, যে কটা খুশি।”
“গতকাল সকালে এখান থেকে রওনা হয়ে, সরাসরি সেনেদের বাড়িতে না গিয়ে, তিন জায়গায় আমরা থেমেছিলুম। প্রথমে একটা চশমার দোকান থেকে আপনি একজোড়া সান- গ্লাস কেনেন। ওটা কেনার কি তখনই খুব দরকার ছিল?”
“ছিল বই কী।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কলকাতা থেকে নিয়ে আসিনি, তাই কিনতে হল। সানগ্লাসের মত্ত সুবিধে। ওটা পরলে আপনি সবাইকে দেখতে পান, কিন্তু আপনার চোখ কেউ দেখতে পায় না। ফলে কেউ বুঝতে পারে না যে, ঠিক কোন দিকে আপনি তাকিয়ে আছেন বা ঠিক কার উপরে নজর রাখছেন।”
“বুঝলুম। কিন্তু তারপরই দুই বন্ধুর বাড়িতেও আপনি গেছলেন। তারা কে?”
“আপনার আগের প্রশ্নটা ভাল ছিল। এটাও বেশ ভাল।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “প্রথম জনের নাম আদিনাথ ঘোয় আর দ্বিতীয় জনের নাম শ্ৰীমন্ত বসাক।…ওহে পরমেশ, তোমরা তো এখানকার পুরনো বাসিন্দা, এঁদের চেনো না?”
“কেন চিনব না?” পরমেশ বললেন, “ওঁরা দুজনেই তো স্ট্র্যান্ডে প্রায়ই হাঁটতে আসেন।”
“ওঁরা কী করেন, তাও জানো আশা করি?”
“জানি বই কী। আদিনাথবাবু শেয়ার মার্কেটের ব্রোকারি করতেন। কলকাতায় ওঁদের ছোটখাটো একটা আপিসও আছে। তবে আজকাল আর উনি বেচাকেনার কাজটা নিজে করেন না। কলকাতার আপিসের কাজকর্মও ওঁর ছেলেই দেখছে। ভদ্রলোকের শেয়ারের জ্ঞান শুনেছি টাটনে। এও শুনেছি যে, আদিনাথবাবু কাজকর্ম থেকে অবসর নিলে কী হয়, কোন শেয়ারটা কেনা ঠিক হবে আর কোনটা হবে না, সেটা বোঝার জন্য এখনও অনেকেই ওঁর কাছে যায়।”
“কারেক্ট। আর শ্ৰীমন্ত বসাক?”
“উনি এখানকার একজন নামজাদা জুয়েলার।” পরমেশ বললেন, “গয়নার ব্যাবসা ছাড়া নানা রকমের প্রেস স্টোনের একটা সাইড বিজনেসও আছে বলে শুনেছি।”
“কারেক্ট এগেন।” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “তুমি বলেছিলে, বিমলভূষণের বিষয়। আশয় নুটু যেভাবে সামলাচ্ছে, তাতে তাকে একজন ঝানু লোক বলেই তোমার মনে হয়। তোমার কথা শুনে আমার মনে প্রশ্ন জাগে যে, এত বড় সম্পত্তির দায়িত্ব যার হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, তলে-তলে সে নিজের আখের গোছাচ্ছে না তো? কিংবা, জুয়া-টুয়া খেলতে গিয়ে কোনও বড় রকমের আর্থিক সমস্যায় পড়ে যায়নি তো? তা এক ঝানু লোকের সম্পর্কে জানতে হলে আর-এক ঝানু লোকের কাছে যাওয়াই ভো নিয়ম, তাই না?”
সদানন্দবাবু বললেন, “বুজিছি। সেই জন্যেই আপনি আদিনাথবাবুর কাঁচে গেসলেন।
ভাদুড়িমশাই বললেন, “ঠিক ধরেছেন। আসলে, হিরের দিকে কে কে হাত বাড়াতে পারে, সেটা ভাবতে গিয়ে নুটুকেও আমার লিষ্টি থেকে আমি বাদ দিইনি। তা আদিনাথ যা বলল, তাতে মনে হল, আমার সন্দেহটা মিথ্যে নয়।
“অর্থাৎ যে রক্ষক, সে-ই ভক্ষক! বিমলভূষণের সম্পত্তির একটা মস্ত অংশ টু হাতিয়ে নিয়েছে, কেমন?”
“না, সদানন্দবাবু,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “এটা আপনি ঠিক কথা বললেন না। সম্পত্তি নই হাতায়নি। টাকাকড়িও না। শুধু তা-ই নয়, পুরনো সম্পত্তি তো সে আগলে রেখেছেই, তার উপরে নতুন সম্পত্তি যা কিছু কিনেছে, তা সবই কিনেছে বিমলভূষণের নামে। সেদিক থেকে সে মোলো-আনার উপরে আঠারো-আনা সৎ। অথচ এক্ষুনি যে তার লাখ-লাখ টাকা দরকার, তাও ঠিক।”
সদানন্দবাবুর মুখ দেখে মনে হল, তিনি ধাঁধায় পড়ে গেছেন। বললেন, “তা কী করে হয়?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “কী করে হয়, তা আদিনাথের কাছেই জানা গেল। সে-ই বলল যে, বছর পাঁচেক আগে বিমলভূষণের নামে সে লাখ পঁচিশেক টাকার শেয়ার কিনেছিল, অ্যাট পার। শেয়ারগুলোর দাম আস্তে-আস্তে বাড়ছিলও। ইন ফ্যাক্ট যদি বছর দুয়েক আগেও বেচে দিত, তা হলে লাভ নেহাত খারাপ থাকত না। কিন্তু তখন বেচেনি। আর তারপরেই দাম হঠাৎ পড়তে শুরু করে।”