“বাঁচাতে হবে কেন,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আর তা ছাড়া, এই হিরে দিয়ে বাঁচানো যায়? এ তো নকল হিরে!”
বলে আর দাঁড়ালেন না। বসতবাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের নিয়ে ফের মন্দিরের দিকে রওনা হলেন।
.
॥ ১১ ॥
মন্দিরে যখন ফিরে যাই, জেনারেটরের ঘটঘট শব্দ তখন বন্ধ হয়ে গেছে। মেন সুইচটা সত্যিই কেউ অফ করে দিয়েছিল। সেটা ফের অন্ করে দেওয়ায় ফিরে এসেছে আসল আলো। চত্বর ছেড়ে যারা চলে গিয়েছিল, তারাও আবার ফিরে এসেছে। আবার জমে উঠেছে ভিড়। হরপার্বতীর হিরে যে পাওয়া গেছে, আর নতুন করে পরিয়েও দেওয়া হয়েছে বিগ্রহের চোখে, এই খবর রটে যাওয়ায় ভিড় ক্রমে আরও বেড়ে চলেছে। কিন্তু সেই ভিড়ের মধ্যে মাতা লুমিয়েরকে দেখতে পেলুম না। বিমলভূষণকে এই নিয়ে প্রশ্ন করতে তিনি বললেন, “সে তো তার দেশের কোন কাগজে ছাপবে বলে ছবি তুলতে এসেছিল। নতুন করে ওই যে আবার বিগ্রহের চোখে হিরে দুটো পরিয়ে দিলুম, তার ছবি তুলে নিয়ে সে আর দাঁড়ায়নি, ক্যামেরা নিয়ে চলে গেছে।”
এরপরে আর মন্দিরে আমরা খুব বেশিক্ষণ থাকিনি। থাকার কোনও দরকারও ছিল না। বিমলভূষণের পরিবারের লোকেরা খানিক আগেই বসতবাড়িতে ফিরে গেছেন। ভাদুড়িমশাই বললেন, “একটু চা পেলে ভাল হত।” শুনে বিমলভূষণ বললেন, “চলুন, বাড়িতে গিয়ে চা খাব।”
এখন আমরা বিমলভূষণদের দোতলার ড্রয়িংরুমে বসে চা খাচ্ছি। চা খেতে-খেতেই বিমলভূষণ বললেন, “যাক, আর হিরে চুরি যাবার ভয় নেই। মন্দিরে দুজন পাহারাদার বসিয়ে রেখে এসেছি। সারাক্ষণ-তারা হরপার্বতীর উপরে নজর রাখবে।”
ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “কিন্তু ও দুটো তো আসল হিরে নয়।”
চা খেতে-খেতেই বিষম খেলেন বিমলভূষণ। তারপর কোনওক্রমে নিজেকে সামলে নিয়ে তোতলাতে-তোতলাতে বললেন, “তা তার মানে?”
‘মানে খুবই সহজ।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিন্তু একটা প্রশ্ন করি। আপনি কি হিরের আসল-নকল বোঝেন?”
“তা কেন বুঝব না খুব ভালই বুঝি।” উত্তেজিত গলায় বিমলভূষণ বললেন, “এটাও বুঝি যে, আমাদের বিগ্রহেব হিরে দুটি একেবারে হানড্রেড পারসেন্ট জেনুইন।”
সদানন্দবাবু বললেন, “টু হানড্রেড পারসেন্ট। সে তো আমি কাল দুপুরে যখন দেকলুম, তখনই বুজিচি! কী জেল্লা।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপনারা দুজনেই কারেক্ট। যে হিরে কাল দুপুরে আমরা দেখেছিলুম, সত্যিই তা মোলো-আন খাঁটি। কিন্তু…”।
বিমলভূষণ বললেন, “এর মধ্যে আবার কিন্তু আসছে কোত্থেকে?”
“আসছে আসছে। তাব কারণ, আজ যে হিরে পরানো হয়, পরাবার পরে চুরি যায়, আর তারপরে আমি উদ্ধার করে আনি, আর তারও পরে আবার বিগ্রহের চোখে বিমলভূষণ যা নতুন করে পরিয়ে দেন, তা কিন্তু সেই কালকের হিরে নয়, স্রেফ নকল।”
“বলেন কী, ও দুটো নকল হিরে? আর আমি তা বুঝতে পারলুম না?”
“শুধু আপনি কেন, কেউই বুঝতে পারেনি।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “পারার কথাও নয়। একে তো ওই হট্টগোল, তার উপরে ফ্লাডলাইট জ্বলছে, আলোর চর্কি ঘুরছে, একেবারে ধাঁধা লাগিয়ে দেওয়া ব্যাপার। তার মধ্যে কে বুঝবে যে, ও দুটো হিরে নয়, কাঁচ? বোঝা সম্ভব?”
“কিন্তু আমি তো সিন্দুক থেকেই ভেলভেটের বাক্স বার করে নিয়ে মন্দিরে গিসলুম। সেই বাক্স থেকে বার করেই তো বিগ্রহের চোখে হিরে দুটো বসিয়ে দিই!”
“বিমলবাবু, আপনার ওই বাক্সটাই জেনুইন, হিরে দুটো নয়।”
“বাক্সের ভিতর থেকে জেনুইন হিরে দুটো ল হলে কে নিল? কখন নিল?”
পট থেকে নিজের পেয়ালায় আবার নতুন করে লিকার ঢেলে নিলেন ভাদুড়িমশাই। তাতে দুধ-চিনি মিশিয়ে চামচ দিয়ে নেড়ে নিলেন। তারপর এক চুমুক চা খেয়ে পেয়ালাটাকে পিরিচে নামিয়ে রেখে বললেন, “কে নিয়েছে, তাও বুঝতে পারেননি। অবিশ্যি পারবেনই বা কী করে? গোয়েন্দা নিজেই যে হিরে চুরি করতে পারে, তা তো আপনার জানার কথা নয়।”
“তার মানে?”
“তার মানে হিরেজোড়া তো প্রথম দেখি কাল দুপুরে। তারপর কাল রাত্তিরে আপনার শোবার ঘরে গিয়ে আপনাকে দিয়ে সিন্দুক খুলিয়ে হিরে দুটোকে যখন দ্বিতীয়বার দেখি, তখনই আপনার ভেলভেটের বাক্স থেকে ও দুটি সরিয়ে নিয়ে তার জায়গায় দুটো নকল হিরে রেখে দিই। কাজটা করেছিলুম মাত্র এক লহমার জন্যে আপনার দিকে পিছন ফিরে। আপনি টেরও পাননি।”
দেখলুম, যেমন বিমলভূষণের, তেমনই সদানন্দবাবুরও চোয়াল ঝুলে পড়েছে। বিমলভূষণ অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “অ্যাঁ?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “হ্যাঁ। এই নিন আপনার আসল হিরে।”
পকেটে হাত দিয়ে ছোট্ট একটা এনভেলাপ বার করে তিনি বিমলভূষণের দিকে এগিয়ে দিলেন। বিমলভূষণ খাম খুলে জিনিস দুটি বার করতেই তা ঝকমক করে উঠল।
বেশ কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে হিরে দুটির দিকে তাকিয়ে রইলেন বিমলভূষণ। তারপর তার হতভম্ব ভাবটা কেটে যেতে মুখ তুলে ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কিন্তু….কিন্তু এই হিরেজোড়া আপনি সরিয়েছিলেন কেন?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “ও দুটো আগে আপনার সিন্দুকে তুলে রেখে আসুন, অন্য কথা তারপরে হবে। যান।”
বিমলভূষণ ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। ফিরে এলেন মিনিট তিন-চার বাদে। তারপর ফের সেই প্রশ্ন তুললেন। “এবারে বলুন সরিয়েছিলেন কেন? আপনি কি জানতেন যে, বিগ্রহের চোখ থেকে ও-দুটো আজ চুরি হবে?”