“আপনাদের হিরের কথা ও জানে?”
“সে তো আমিই ওকে বলেছি। সেই হিরের চোখের হরপার্বতী দেখতেই তো ওর আসা। কাল ভোরেই ঠিক এখানে এসে যাবে।”
“এবারে শেষ প্রশ্নটা করি। নুটু লোকটি কেমন? ওকে আপনি কতটা বিশ্বাস করেন?”
“পুরোপুরি বিশ্বাস করি।” বিমলভূষণ বললেন, “না করে উপায় আছে? ওই তো সব সামলাচ্ছে।”
“বাস,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “অনেকক্ষণ আপনাকে আটকে রেখেছি, এবারে আপনার ছুটি। সন্ধের দিকে একবার আসব। এখন যান, একটু গড়িয়ে নিন।
বিমলভূষণ সোফা থেকে উঠে দরজা পর্যন্ত আমাদের এগিয়ে দিলেন। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে আমরা নীচে নেমে এলুম। রওনা হলাম গেস্ট হাউসের দিকে।
গেস্ট হাউসের মুখে নুটুর সঙ্গে দেখা। তিনি বললেন, “দোতলায় চলে যান, ওখানে আপনাদের জন্যে দুটো ঘর রেডি করে রেখেছি।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপনাদের পুজুরি ঠাকুরটির সঙ্গে একটু কথা বলব। তাকে পাওয়া যাবে?”
“নিশ্চয়ই যাবে।” নুটু বললেন, “নীচেই আছেন। আপনারা ঘরে যান, আমি তাঁকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
আমরা উপরে উঠে সিঁড়ির পাশের ঘরটা আমার ও সদানন্দবাবুর জন্য রেখে ধারের ঘরটা ভাদুড়িমশাইকে ছেড়ে দিলুম। গাড়ি থেকে আমাদের হ্যান্ডব্যাগ তিনটি উপরে তুলে দেওয়া হয়েছিল। জামাকাপড় পাল্টে ভাদুড়িমশাইয়ের ঘরে বসে সবে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরু করেছি, এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল।
দরজা খুলে যাকে দেখা গেল, তার বয়স বছর তিরিশ-বত্রিশের বেশি হবে না। গৌরবর্ণ যুবা পুরুষ, পরনে গরদের ধুতি, ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত, গলায় ধবধবে সাদা উপবীত। নমস্কার করে বললেন, “আমার নাম শ্রীগৌরাঙ্গ ভট্টাচার্য। আমিই এই মন্দিরের পূজারি। নুটুবাবু বললেন, আপনারা আমার সঙ্গে কথা বলতে চান।”
ঘরে একটিমাত্র চেয়ার। গৌরাঙ্গ ভট্টাচার্যকে সেটায় বসতে বলে আমরা তিনজন খাটের উপরে বসলুম। ভাদুড়িমশাই কোনও ভণিতার মধ্যে না গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি এখানে কত দিন আছেন?”
“পাঁচ বছর।” গৌরাঙ্গ বললেন, “আগে আমার বাবা এখানে পূজো-পাঠ করতেন। তিনি অসুস্থ হয়ে দেশের বাড়িতে চলে যান। তখন থেকে আমিই এখানে কাজ করছি।”
“আপনাদের দেশ কোথায়?”
“বর্ধমান জেলার শক্তিগড়ে। সেখানে রেলগাড়ি থেকে নেমে মাইল পাঁচেক সাইকেল রিকশায় যেতে হয়। গ্রামের নাম বড় চণ্ডীপুর।”
ভাদুড়িমশাই একটা সিগারেট ধরালেন। দেশলাই কাঠিটা নিভিয়ে ঘরের মধ্যে অ্যাশট্রে না থাকায়, জানলা দিয়ে বাইরে নিক্ষেপ করলেন। তারপর বললেন, “ভটচাজমশাই, আপনি কি নিত্য গঙ্গাস্নান করেন?”
গৌরাঙ্গ বললেন, “শরীর ভাল থাকলে নিত্যই করি। তবে শরীর তো নিত্য ভাল থাকে না। তখন এক-আধ দিন বাদ যায়।” জোড়া ভাদুড়ি-৪
ভাদুড়িমশাই আর কথা না বাড়িয়ে এবারে সরাসরি চলে এলেন হিরের প্রসঙ্গে। বললেন, “বিমলবাবু বলছিলেন যে, গঙ্গার ঘাটে দুজন লোককে আপনি হিরে নিয়ে বলাবলি করতে শুনেছিলেন। এটা কবেকার কথা?”
“গত মাসের মাঝামাঝির।” একটুক্ষণ চিন্তা করে গৌরাঙ্গ বললেন, “মার্চ মাসের চোদ্দো-পনেরো তারিখের।”
“তারা কী বলছিল।”
“বলছিল যে, ও-হিরে সেনেদের নয়, ওরা এক সায়েবের কাছ থেকে হাতিয়েছে, তাই চুরি করলে পাপ হবে না।”
“ঠিক এই কথাই আপনি বিমলভূষণকে বলেছিলেন?”
“আজ্ঞে না।” গৌরাঙ্গ সামান্য হাসলেন। বললেন, “ওভাবে কি বলা যায়? আমি শুধু বলেছিলাম যে, হিরে নিয়ে দু’জন লোককে কথা বলতে শুনেছি, তাই সাবধান হওয়া দরকার।”
“লোক দু’জন কোথাকার বলে মনে হয়?”
“তা তো জানি না। তবে চেহারা আমার মনে আছে। একজন ঢ্যাঙা, অন্যজন বেঁটে। দুজনেই কালো। বেঁটে লোকটার গালে একটা আঁচিল আছে। আবার দেখলে ঠিক চিনতে পারব।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “ঠিক আছে ভটচাজমশাই, আপনি যেতে পারেন।” গৌরাঙ্গ ভট্টাচার্য চলে গেলেন।
ভেবেছিলুম, জামাকাপড় পালটে ভাদুড়িমশাইও এবারে একটু বিশ্রাম করে নেবেন। কিন্তু তিনি জামাকাপড় পালটালেন না। দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, “আপনারা বিশ্রাম করুন, গাড়িটা নিয়ে আমি একটু বেরুচ্ছি। পাঁচটা নাগাদ ফিরব।”।
কোথায় কী কাজে তিনি বেরিয়ে গেলেন, তা জানি না, তবে ফিরে এলেন পাঁচটার মধ্যেই। আমি ও সদানন্দবাবু ইতিমধ্যে একটু ঘুমিয়ে নেবার চেষ্টা করেছি। তবে সদানন্দবাবুর ক্ষেত্রে চেষ্টাটা কিঞ্চিৎ সফল হলেও আমার ক্ষেত্রে একেবারেই হয়নি। ভাদুড়িমশাই ফিরে এসেই বললেন, “চলুন, স্ট্যান্ড থেকে এক চক্কর ঘুরে আসা যাক।”
যেতেই হয়েছিল। সেখানে পরমেশ চৌধুরির সঙ্গে দেখাও হয়ে গেল আবার। ভদ্রলোক একটা বেঞ্চিতে বসে তারই বয়সী জনা তিনেক বন্ধুর সঙ্গে গল্প করছিলেন। ভাদুড়িমশাইকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “তোমার কাজ কেমন এগোচ্ছে?” তাতে ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “ভালই।” শুনে খুশি হলেন পরমেশ। বললেন, “কলকাতায় ফেরার আগে কিন্তু একটা দিন আমার বাড়িতে কাটিয়ে যেয়ো।”
স্ট্যান্ড থেকে ফিরতে-ফিরতে রাত হয়ে যায়। ফিরে সেনেদের মূল বাড়িতে যাই। সেখানে বিমলভূষণের সঙ্গে ভাদুড়িমশাইয়ের একান্তে কিছু কথা হয়। তারপর ওখানেই রাতের খাওয়া চুকিয়ে একটু আগে গেস্ট হাউসে ফিরেছি। ফিরে ভাদুড়িমশাইকে জিজ্ঞেস করেছিলুম, বিমলভূষণের সঙ্গে তার কী কথা হল। তাতে তিনি হেসে বললেন, “কথা তো বিশেষ হয়নি। তবে হ্যাঁ, ওঁর শোবার ঘরে ঢুকে সিন্দুক খুলিয়ে ওই হিরেজোড়া আর একবার দেখে এলুম।” তারপর এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, “তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ুন। রাত জাগবেন না। কাল ভোর পাঁচটার আগেই নীচে নামতে হবে।”