প্রথমে চশমা কেনা, তারপর দুই বন্ধুর সঙ্গে অতক্ষণ ধরে কথা বলা, ফলে সেনেদের বাড়িতে যেখানে ন’টার মধ্যে পৌঁছবার কথা, সেখানে বারোটারও একটু পরে আমরা পৌঁছই।
পৌঁছে আমি প্রথমটায় একটু অবাক হয়ে গিয়েছিলুম। পরক্ষণেই অবশ্য মনে হয় যে, এমনটা যে দেখব, তা আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল। বসতবাড়ির পাশের জমিতে মন্দির। জমির অন্য দিকে ছোট্ট একটি দোতলা বাড়ি। মাঝেখানের বাধানো বিশাল চত্বর জুড়ে মস্ত বড় ম্যারাপ খাটানো হয়েছে। এখন চলছে নকশাকাটা সাদা কাপড় দিয়ে বাঁশ ও তেরপলকে ঢাকা দেওয়ার কাজ। ডেকরেটরের লোকজন ছুটোছুটি করছে, বাঁশে পেরেক ঠোকার ঠকঠক শব্দ উঠছে সারাক্ষণ। তারই মধ্যে জনা তিন-চার লোক পায়জামা পাঞ্জাবি-পরা একজন বছর-পঁয়ত্রিশ বয়সের রোগামতন ভদ্রলোককে ঘিরে ধরে বলছে যে, এদের কাজ যদি না বিকেলের মধ্যে শেষ হয় তো তারা আলোর ব্যবস্থা করবে কখন?
আমরা গাড়ি থেকে নামতে ভদ্রলোক আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বললেন, “আপনারা?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমরা কলকাতা থেকে আসছি। বিমলবাবুর সঙ্গে দেখা করতে চাই।”
“ও, বুঝতে পেরেছি।” ভদ্রলোক বললেন, “আপনারা আমার সঙ্গে আসুন। মামাবাবু এখানেই ছিলেন, একটু আগে বাড়ি গেছেন। আসুন।”
বুঝলুম যে, এই হচ্ছে নুটু, অর্থাৎ বিমলভূষণের সেই ভাগ্নে। বাড়ি বলতে এ যে সেনেদের বসতবাড়ির কথা বোঝাচ্ছে, তাও বোঝা গেল।
মন্দিরপ্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে একটা গেট পেরিয়ে বসতবাড়ির এলাকায় ঢুকে পড়া গেল। মস্ত বড় কম্পাউন্ডওয়ালা চুন-সুরকির সেকেলে বিশাল দোতলা বাড়ি। বিলিতি ম্যাগাজিনের ইলাসট্রেশনে ম্যানর হাউসের যে-সব ছবি দেখা যায়, এটিও দেখতে অনেকটা সেইরকম। কম্পাউন্ডের জমিতে অনায়াসেই বাগান করা চলত, কিন্তু সেসব করার কোনও চেষ্টা কখনও হয়েছে বলে মনে হয় না, সর্বত্র শুধু ঘাসই চোখে পড়ে। বাড়িটিও ল্যাপাপোঁছা ধরনের। তবে মেনটেন্যান্সে যে কোনও ত্রুটি নেই, সেটা বোঝ যায়। ত্রুটি ঘটলে এখানে-ওখানে ফাটল চোখে পড়ত। দেখা যেত যে, ফাটলের মধ্যে বট-অশথের চারা গজিয়ে গেছে। সে-সব চোখে পড়ল না। সদ্য বাড়িটির কলি ফেরান হয়েছে, তাও বুঝলুম। তবে, বাড়িটির আর্কিটেকচারাল প্যাটার্ন যতই না শ্রীহীন হোক, আয়তনে এটি এতই বিশাল যে, তাতেই খানিকটা সম্ভ্রমের উদয় হয়।
সামনের দরজাটিও বেশ বড়। টুর পিছন-পিছন ভিতরে ঢুকে দেখলুম, বেশ চওড়া একটি কাঠের সিঁড়ি দোতলায় উঠে গেছে। নটু অবশ্য দোতলায় উঠল না, আপনারা উপরে উঠে যান, মামাবাবু দোতলায় থাকেন বলে ডানদিকের একটা ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। পর্দার আড়ালে-একটি তরুণী ও বাচ্চা একটি ছেলের মুখও চকিতে চোখে পড়ল আমার। সম্ভবত নুটুর বউ ও ছেলে।
আমরা দোতলায় উঠে ডোর-বেলের বোতাম টিপবার কয়েক সেকেন্ড বাদে যিনি এসে দরজা খুলে দিলেন, তাকে যেহেতু আগেই আমরা দেখেছি, তাই চিনতে অসুবিধে হল না। বিমলভূষণ আজ অবশ্য অন্য পোশাক পরেছেন। তার পরনে আজ সিল্কের পায়জামা ও পাঞ্জাবি। পায়ে শুড়-তোলা চটিজুতো। আমাদের দেখে যে একটু অবাক হয়েছে, তা তার চোখ দেখেই বোঝা গেল। বললেন, “আসুন, আসুন। কিন্তু আপনাদের তো কালই আসার কথা ছিল। এলেন না যে? কাজে আটকে গেসলেন?”
এর উত্তরে সত্য কথা বললে স্পষ্ট জানাতে হত যে, আমরা কালই এসেছি বটে, কিন্তু উঠেছিলুম অন্য জায়গায়। ভাদুড়িমশাই অবশ্য সত্যও বললেন না, মিথ্যে বললেন না। প্রশ্নটাকে বেমালুম এড়িয়ে গিয়ে বললেন, “চুরিটা আটকে দেওয়াই হচ্ছে আসল কথা। আশা করি, আটকে দিতে পারব। চলুন, আপনাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করার আছে।”
বিমলভূষণের যেন হঠাৎই খেয়াল হল যে, আমাদের তখনও দরজায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে, বসতে বলা হয়নি। শশব্যস্ত হয়ে বললেন, “আরে কী কাণ্ড, আপনারা দাঁড়িয়ে রইলেন কেন, আসুন, আসুন, ভিতরে এসে বসুন।”
দরজা পেরোলেই মস্ত ড্রয়িংরুম। এক দিকে একটি ডিভান। মাঝখানে বড়সড় সেন্টার টেবিল ঘিরে গোটা কয়েক শসোফা। দেওয়াল ঘেঁষে জানালার-তেলাঞ্চি-সমান-উঁচু টানা কাঁচের আলমারি। তাতে দেশি ও বিদেশি নানারকমের পুতুল সাজানো। অন্যদিকের দেওয়ালে পাশাপাশি তিনটি তেলরঙা পোর্ট্রেট। আমরা সেদিকে তাকিয়ে আছি দেখে বিমলভূষণ বললেন, “বাঁদিক থেকে আমার বাবা, ঠাকুর্দা আর ঠাকুর্দার বাবা।”
সদানন্দবাবু বললেন, “অর্থাৎ চন্দ্রভূষণ, কীর্তিভূষণ আর কালীভূষণ। ঠিক বলিচি?” বিমলভূষণ বললেন, “ঠিকই বলেছেন।…কিন্তু কলকাতা থেকে আপনারা স্নান সেরে বেরিয়েছেন তো? নাকি এখানেই স্নান করে নেবেন?”
“ও-সব সেরে তবেই রওনা হয়েছি।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপনি ব্যস্ত হবেন না। বরং কাজের কথা শুরু করা যাক।”
“কাজের কথা পরে হবে।” বিমলভূষণ হেসে বললেন, “অনেক বেলা হয়ে গেছে। আপনারা আগে খেয়ে নিন। আমরাও দুপুরের খাওয়া এখনও খাইনি। সবাই একসঙ্গে বসে খেয়ে নেব। কাজের কথা তার পরে হলেও ক্ষতি নেই। কথা সেরে তারপর গেস্ট হাউসে যাবেন। ওখানেই আপনাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে।”
তা-ই হল। বিমলভূষণ ভিতরে চলে গিয়ে মিনিট দুই-তিন বাদে আবার ঘুরে এসে বললেন, “আপনারা আসুন। খেতে দেওয়া হচ্ছে। আমার স্ত্রী সবাইকে ডাইনিং রুমে নিয়ে যেতে বললেন।”