“একতলার একদিকে দুটো ঘর নিয়ে থাকে নটরা। বাকি ঘরগুলোতে চাকর-বাকরেরা থাকে।”
একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর বললেন, “বিমলভূষণের আর্থিক অবস্থা কীরকম? কালীভূষণ শুনেছি বিস্তর জমিজমা করেছিলেন। কিন্তু জমিদারি প্রথা তো লোপ পেয়েছে, বিমলভূষণও খুব-একটা করিতকর্মা লোক বলে মনে হয় না। ওদের সোর্স অব ইনকামটা তা হলে কী?”
“সোর্স অব ইনকাম প্রচুর।” পরমেশ হেসে বললেন, “জমিদারি গেছে বলে তো আর তাবৎ স্থাবর সম্পত্তি লোপ পায়নি। এই চন্নননগরে ওদের বাড়ি রয়েছে তা অন্তত দশ বারোটা, বাজারে দোকানঘরও কিছু কম নেই। তার থেকে ভাড়া নেহাত কম মেলে না। তা ছাড়া ওই শিবমন্দির থেকেই কি ইনকাম কিছু কম হয় ভেবেছ? কালীভূষণ ওই একটা জিনিস বানিয়ে গেছেন বটে।”
“বুঝলুম।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিন্তু এতসব সম্পত্তি সামলে রাখার ঝামেলাও তো কিছু কম নয়। সে-সব কে করে?”
“এই নুটুই করে। বাড়ি আর দোকানঘরের ভাড়া আদায় থেকে মন্দিরের দর্শনী, প্রণামীর টাকাপয়সার হিসেব রাখা, বিল মেটানো, রসিদ দেওয়া, লোক লাগানো, মজুর খাটানো–মানে এ টু জেড–সবই ও একা করে।”
“মন্দির যখন আছে, তখন একজন পুজরি ঠাকুরও আছেন নিশ্চয়?”
“তা আছেন বই কী।”
“তিনি থাকেন কোথায়?”
“ওখানেই থাকেন। তবে মূল বাড়িতে থাকে না। বাড়ির বাইরে একটা গেস্ট হাউস আছে। তার একতলায় আর দোতলায় দুটো-দুটো করে চারটে ঘর। পুজুরি ঠাকুর থাকেন একতলায়। তোমরা সম্ভবত দোতলায় থাকবে।”
শুনে, আবার একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। একটা সিগারেট ধরালেন। দেশলাই-কাঠিটাকে শূন্যে বার দুয়েক নেড়ে, নিবিয়ে, আঙুলের টোকা মেরে দুরে নিক্ষেপ করলেন। তারপর বললেন, “একটা কথা জিজ্ঞেস করি, পরমেশ। একটু ভেবেচিন্তে উত্তর দিয়ো। নুটু লোকটি কেমন?”
পরমেশ হেসে বললেন, “যে-ভাবে সব সামলাচ্ছে, তাতে তো বেশ ঝানু লোক বলেই মনে হয়। বিমলকে বলতে গেলে প্রায় কিছুই করতে হয় না, কাগজ এগিয়ে দিলে সই করেই খালাস, ভাগ্নেটাকে পেয়ে বেঁচে গেছে।… তা তোমরা কাল ব্রেকফাস্টের পরেই চলে যাবে কেন, অন্তত লাঞ্চটা করে তারপর যাও।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “না হে পরমেশ, আর তো সময়ই নেই, কাল সকালেই যাওয়া ভাল।”
এরপরে আর কথা বিশেষ হল না। আরও খানিকক্ষণ ছাতে বসে থেকে আমরা একতলায় নেমে এলুম। ঘরে ঢুকে দেখলুম, অল্প পাওয়ারের একটা হালকা নীল আলো জ্বালিয়ে রেখে সদানন্দবাবু অঘোরে ঘুমোচ্ছন।
নীল আলোটার দিকে অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে থাকতে-থাকতেই একেবারে ঝট করে একটা কথা মনে পড়ল আমার। মার্ত্যা লুমিয়েরকে কলকাতায় প্রথম দেখার পর কৌশিক তার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছিল যে, লোকটির চোখের তারা নীল। কিন্তু শ্রীরামপুর ছাড়িয়ে একটা ধাবার সামনে যে মাতা লুমিয়েরকে আমরা দেখি, তার চোখের তারা মোটেই নীল নয়, বাদামি। লোকটাকে দেখার পর থেকেই যে কেন একটা অস্বস্তির কাটা আমার মনের মধ্যে খচখচ করছিল, এতক্ষণে সেটা বুঝতে পারা গেল।
.
॥ ৯ ৷৷
আজ তেরোই এপ্রিল, মঙ্গলবার। সারাটা দিন নানা কাজে আর হরেকরকম লোকের সঙ্গে কথা বলে কেটেছে। এরই মধ্যে বিকেলে একবার স্ট্র্যান্ড থেকেও এক চক্কর বেড়িয়ে আসা গেল। এখন রাত ন’টা বাজে। একটু আগে বিমলভূষণ, তার স্ত্রী ও মেয়ে জামাইয়ের সঙ্গে এঁদের বসতবাড়ির দোতলার ডাইনিং রুমে বসে রাতের খাওয়া সেরে নিয়েছি। তারপর চলে এসেছি এই গেস্ট হাউসের দোতলায়। দোতলায় দুটি ঘর। মাঝখানে বাথরুম। দুদিকের ঘর থেকেই বাথরুমে যাওয়া যায়। যে-দিক থেকেই যিনি যান, অন্য দিকের দরজাটা বন্ধ করে দিলেই হল।
এখন বলি, আজ সকাল থেকে কী কী ঘটেছে।
সকালের ট্রেনেই কৌশিক কলকাতায় ফিরে গেছে। শেষ রাত্তিরে স্ট্র্যান্ড থেকে জগিং সেরে এসে ভাদুড়িমশাই তাকে ঘুম থেকে তুলে দেন। রিকশাওয়ালাকে পরমেশ তো বলেই রেখেছিলেন, সেও ঠিক-সময়ে এসে কৌশিককে নিয়ে স্টেশনে পৌঁছে দিয়েছে।
কথা ছিল পরমেশ চৌধুরির বাড়িতে ব্রেকফাস্ট করেই আমরা সরাসরি সেনেদের বাড়িতে চলে আসব। ব্রেকফাস্ট শেষ করি সাড়ে আটটায়। মহকুমা সদর হলেও চন্দননগর যে খুব ছোট শহর, তা নয়, আসানসোলের কথা ছেড়ে দিলে আর-পাঁচটা মহকুমা-সদরের তুলনায় মোটামুটি বড়ই বলতে হবে। রাস্তাঘাটে গাড়িঘোড়ার ভিড় লেগেই আছে। দোকানপাটও বেশ জমজমাট। তবু, কথা অনুযায়ী কাজ হলে ন’টার মধ্যে আমরা সেনেদের বাড়িতে পৌঁছে যেতে পারতুম। কিন্তু কথা অনুযায়ী কাজ হয়নি। ভাদুড়িমশাই কাল রাত্তিরে বলেছিলেন যে, ব্রেকফাস্ট সেরে সরাসরি আমরা এখানে চলে আসব। কিন্তু পরমেশবাবুর বাড়ি থেকে রওনা হবার পরই তার প্ল্যান পালটে যায়। পথের মধ্যে তিন জায়গায় তিনি গাড়ি থামান। প্রথমে একটা চশমার দোকানে ঢুকে হালকা মভ কালারের একজোড়া রোদ-চশমা কেনেন। তারপর থামেন আরও দু’জায়গায়। দুটোই নাকি তার পুরনো বন্ধুর বাড়ি। বললেন, অনেক দিন বাদে চন্দননগরে এসেছেন, আবার কবে আসা হবে তার ঠিক নেই, তাই এই সুযোগে বন্ধুদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎটা সেরে নিতে চান।
দুই বন্ধুর সঙ্গে কী কথা হয়েছিল, আমরা জানি না। তার কারণ, আমি ও সদানন্দবাবু গাড়ির মধ্যেই সারাক্ষণ বসে ছিলুম, দুটি বাড়ির কোনওটিতেই আমরা ঢুকিনি। তবে ভাদুড়িমশাইয়ের সঙ্গে তাদের নেহাত কুশল বিনিময় হয়ে থাকলে এক-একটা সাক্ষাৎকারে নিশ্চয় ঘণ্টা দেড়েক করে সময় লেগে যেত না। কথা শেষ হবার পর ভাদুড়িমশাইকে বিদায় জানাতে তারা যখন রাস্তায় নেমে আসেন, তখন অবশ্য এক পলকের জন্যে হলেও দু’জনকেই আমরা দেখেছি। দু’জনেরই বয়স মনে হল সত্তর-বাহাত্তর হবে। দ্বিতীয় বাড়ির বন্ধুটির একটা কথাও শুনেছি আমরা। কথাটা হল : “তা ধরো লাখ দশ-বারো তো হবেই। কিছু বেশিও হতে পারে।”