সদানন্দবাবু হাঁ করে সব শুনছিলেন। ভাদুড়িমশাই চুপ করতেই হা বন্ধ করে তিনি আমার দিকে তাকালেন। আমি বললুম, “কী ভাবছেন?”
“ভাবছি যে, এই হিরেজোড়াও চোরাই মাল নয় তো?”
“হতেই পারে।” ভাদুড়িমাশাই বললেন, “এ দুটোও হয়তো কোথাও কোনও বিগ্রহেরই চোখ ছিল। পিয়ের আঁতোয়ান সেখান থেকে হাপিস করে চন্দননগরে চলে আসে।”
“তা তো বুজলুম।” সদানন্দবাবু বললেন, “কিন্তু তত দামি জিনিস সে শান্তিলতাকে উপহার দিতে গেল কেন? বাপ রে, কতায় বলে সাত রাজার ধন এক মাণিক্য। আর এ তো একজোড়া। চোদ্দো রাজার ধন বললেই হয়। দুম করে সেটা সে কিনা একজন ইন্ডিয়ান লেডিকে দিয়ে ক্লি। ভাবা যায়? কী ব্যাপার বলুন তো?”
ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “থাক, থাক্, ও নিয়ে আব গবেষণা করে লাভ নেই। দিয়েছে, বেশ করেছে। আর তা ছাড়া, এমন একজনকেই তো দিয়েছে, বুড়ো বয়সেও যার সেবা যত্নের কথা সে ভুলতে পারেনি। সত্যিই পারেনি। নয়তো নাতির কাছে পিয়ের কেন বারেবারে সেই সেবাযত্নের গল্প করবে? না না, মিথ্যে বলছি না। লুই তার চিঠিতেই তা জানিয়েছে।”
চিঠিখানা খুলে ধরলেন ভাদুড়িমশাই। তা থেকে লাইন দুয়েক পড়ে শোনালেন। তারপর বললেন, “যচ্চিলে, আপনারা তো আবার ফরাসি বুঝবেন না।…. ওহে পরমেশ, তুমি এই জায়গাটা পড়ে এঁদের একটু বাংলায় বুঝিয়ে বলল তো।’
পরমেশ হেসে বললেন, “আমি ফরাসি জানি ঠিকই, কিন্তু ওই হাতের লেখার পাঠোদ্ধার করতে পারব না। তুমিই বুঝিয়ে বলে, চারুদা।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা হলে শুনুন। লুই লিখছে যে, তার ঠাকুর্দা তাদের কাছে প্রায়ই সেই দয়াবতী মহিলার অর্থাৎ শান্তিলতার গল্প করতেন। বলতে যে, তাঁর সেবাযত্নেরও তুলনা হয় না, আবার রান্নার হাতও ছিল অসাধারণ। শান্তিলতা তাঁকে যে পোয়র কারি বেঁধে খাইয়েছিলেন, তার স্বাদ নাকি তিনি বুড়ো বয়েসেও ভুলতে পারেননি।…বুঝুন।”
সদানন্দবাবু বললেন, “বুজলাম। কিন্তু পোয়র কারিটা কী বস্তু?” আমি হেসে বললাম, “মাছের ঝোল। ওইটুকু ফরাসি আমি জানি।”
.
॥ ৮ ॥
রাত এখন সাড়ে নটা। একটু আগে আমাদের নৈশাহার সমাধা হয়েছে। পাবদা মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেতে-খেতে সদানন্দবাবু একবার গম্ভীর গলায় বলেছিলেন, “পোয়াসঁর কারিটা দেকচি দিব্যি হয়েছে।” শুনে আমরা হেসেও উঠেছিল, তবে ডিনার টেবিলে এ ছাড়া আর অন্য কোনও কথা হয়নি। তারপরে আমরা এ-বাড়ির ছাতে এসে বসেছি। শুনেছি, ছাত থেকে গঙ্গা দেখা যায়। কিন্তু ঝড়বৃষ্টির নামগন্ধ না-থাকলেও হালকা মেঘে আকাশ ঢাকা, ফলে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। স্ট্র্যান্ডের দিক থেকে মাঝে-মাঝে এক-আধ ঝলক বাতাস ছুটে আসছে, তাতে মৃদু একটা ফুলের গন্ধও পাচ্ছি। এটাই কি জাকারাণ্ডার গন্ধ? কে জানে।
সদানন্দবাবু আর ছাত পর্যন্ত আসেননি। খাওয়ার পাট চুকে যাবার পরে বললেন, বড্ড ধকল গেছে, তিনি আর রাত জাগতে পারবেন না। ড্রয়িং রুমের পশ্চিম দিকের ঘরটা বরাদ্দ হয়েছে আমার ও সদানন্দবাবুর জন্যে। তিনি সেখানে চলে গেলেন।
খানিকটা সময় চুপচাপ কাটল। তারপর ভাদুড়িমশাই বললেন, “কৌশিক তো কাল ভোরের ট্রেনেই কলকাতা চলে যাচ্ছে, তোমাকে আর তার জন্যে কষ্ট করতে হবে না, পরমেশ, আমি এমনিতেই শেষ রাত্তিরে উঠে পড়ি, ওকে আমিই গিয়ে স্টেশনে ছেড়ে দিয়ে আসব।”
পরমেশ বললেন, “তোমাকেও কষ্ট করতে হবে না। আমি রিকশাওয়ালাকে বলে রেখেছি। চেনা লোক, সে-ই ঠিক সময়ে এসে ওকে নিয়ে যাবে।”
কৌশিক বলল, “তা তো হল, কিন্তু ঘুম থেকে আমাকে তুলে দেবে কে?”
“তার জন্যে তো আমিই আছি।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “ও নিয়ে ভাবিস না, তোকে তুলে দিয়ে তারপর আমি জগিং করতে যাব।”
“তা হলে আমিও নীচে গিয়ে শুয়ে পড়ি।” কৌশিক বলল, “তোমরা গল্প করো, আমি আর রাত জাগব না।”
কৌশিক নীচে চলে যাবার পর ভাদুড়িমশাই বললেন, “শোনো হে পরমেশ, এবারে দু’একটা কাজের কথা বলি। কৌশিক তো কাল ভোরের ট্রেনে চলে যাচ্ছে, আমরাও কাল তোমার এখানে ব্রেকফাস্ট করে তারপর সেনেদের বাড়িতে চলে যাব। পরশু সংক্রান্তি, সম্ভবত সাত-সকালেই হরপার্বতীর চোখে হিরের মণি পরানো হবে। হিরে যদি চুরি হয়ই, তো আমার ধারণা সেই সময়েই হবে। তার আগে গোটা জায়গাটা আমার একটু দেখে রাখা দরকার। বাড়ির লোকজনদেরও মোটামুটি চিনে রাখতে চাই। ও বাড়িতে কে কে থাকে, তুমি জানো?”
“তা কেন জানব না?” পরমেশ বললেন, “বিমলভূষণের ছেলে নেই, থাকার মধ্যে আছে একটি মেয়ে। তবে তার বিয়ে হয়ে গেছে, সে শ্রীরামপুরে তার শ্বশুরবাড়িতে থাকে। একটু দূর-সম্পর্কের এক ভাগ্নে অবশ্য তার বউ আর বাচ্চা নিয়ে বছর পাঁচেক আগে বিমলভূষণের কাছে এসে উঠেছিল, তখন থেকে তারা ওখানেই রয়ে গেছে। তাও বাড়িটা যেন খাঁ-খাঁ করে।”
“কেন?”
“সে তুমি বাড়িটা দেখলেই বুঝতে পারবে। বনেদি পরিবারের সেকেলে বিরাট বাড়ি। একতলা-দোতলা মিলিয়ে অগুন্তি ঘর। অথচ লোক মাত্র পাঁচজন। বিমলভূষণ, তার বউ কনক, ভাগ্নে নই, ভাগ্নে-বউ আর তাদের বছর আট-দশের একটি ছেলে। বাস।”
“বিমলভূষণরা কোন তলায় থাকে?”
“দোতলায়। দুটি তো প্রাণী। বিমল আর তার বউ। তবে ওদের মেয়ে-জামাই এই সময়ে আসে, তারা হয়তো এসে থাকতে পারে।”
“আর একতলায়?”