চিঠির ভাঁজ খুলে একবার মাত্র চোখ বুলিয়েই সেটা আবার ভাদুড়িমশাইকে ফিরিয়ে দিলেন পরমেশ। বললেন, “ওরে বাবা, এ তো দেখছি কাগের ঠ্যাং আর বগের ঠ্যাং! এ হাতের লেখা আমি পড়তে পারব না। তুমি পেরেছ?”
“পেরেছি বললে বাড়িয়ে বলা হবে।” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “শুধু যে হাতের লেখাটাই কদর্য, তা তো নয়, বানান জানে না, ব্যাকরণ অশুদ, চিঠিখানা যার লেখা, সে যে ঘোর অশিক্ষিত লোক, তাতে সন্দেহ নেই। টেনেবুনে একটা অর্থ অবশ্য করেছি।”
এক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর বললে “অবশ্য পরিষ্কার কোনও অর্থ যে এ-ক্ষেত্রে থাকবেই, এমন আশা করাটাই হয়তো বোকামি হয়ে যাচ্ছে।”
পরমেশ বললেন, “কেন?”
ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “তোমার প্রশ্ন থেকেই বুঝতে পারছি যে, চিঠির উপরকার ঠিকানাটাও তুমি দ্যাখোনি। নাও, সেটা অন্তত পড়ে দ্যাখো।”
হাত বাড়িয়ে ভাদুড়িমশাইয়ের কাছ থেকে চিঠিখানা আবার নিলেন পরমেশ। তারপর ঠিকানায় চোখ বুলিয়েই কৌতুকের সঙ্গে বিস্ময় মেশানো একটা ভঙ্গি করে বললেন,
“ওরেব্বাবা, এ তো পাগলাগারদ থেকে লেখা!”
কৌশিক বলল, “কী হচ্ছে মামাবাবু, আমরা ফরাসি জানি না বলে কি তোমরা দুজনে শুধু নিজেদের মধ্যেই হাসাহাসি করবে নাকি? আমাদেবও একটু বুঝিয়ে বলল।”
“বলছি।” ভাদুড়িমশাই এতক্ষণ দাঁড়িয়ে-পঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। এবারে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাই বার করে একটা সিগারেট ধরালেন। তারপর মুখ থেকে গলগল করে একরাশ ধোঁয়া বার করে বললেন, “এইক্স-এর নাম শুনেছিস?”
“না।” কৌশিক বলল, “ওটা কী বস্তু? খায়, না গায়ে মাখে?”
রসিকতাটাকে আমল না-দিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “দক্ষিণ ফ্রান্সের বন্দর মার্শাইয়ের নাম তো শুনেছিস, এই শহরটা তার খুব কাছেই। এই চিঠিটা সেখানকার….”
কথাটা লুফে নিয়ে কৌশিক বলল, “সেখানকার এক পাগলাগারদ থেকে লেখা হয়েছে, এই তো?”
“পাগলাগারদ নয়,” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “পরমেশ ওটা মজা করে বলছিল। আসলে লেখা হয়েছে এইক্স-এর একটা প্রাইভেট নার্সিং হোম থেকে। সেখানে অবশ্য সব রকমের রোগীদের নেওয়া হয় না, ভর্তি করা হয় শুধু মেন্টাল পেশেন্টদের।”
“তো সেই নার্সিংহোম থেকে একজন পেশেন্ট এই চিঠি লিখেছে?”
“হ্যাঁ।”
“কী লিখেছে?” ভাদুড়িমশাই এই প্রশ্নের উত্তরে যা বললেন, সংক্ষেপে সেটা এইরকম :
চিঠির তারিখ সম্পর্কে হরসুন্দর ভুল বলেননি। এ-চিঠি ১৯৭০ সালেই লেখা বটে। যিনি লিখেছেন, তাঁর নাম লুই আঁতোয়ান। তিনি জানাচ্ছেন যে, বাজারে তার দেনার পরিমাণ আড়াই লাখ ফ্রা। ছ’মাসের মধ্যে যদি না এই দেনা মেটাতে পারেন, তা হলে পাওনাদারেরা তাকে জেলে পাঠাবে। মাদাম শান্তিলতা সেন যদি আজ বেঁচে থাকতেন, তা হলে তার পুরনো বন্ধু পিয়ের আঁতোয়ানের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধার প্রতীক হিসেবে পিয়েরের নাতির এই দুর্দিনে তিনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন নিশ্চয়। কিন্তু মাদাম অথবা তার পুত্র কীর্তিভূষণ তো বেঁচে নেই, তাই বাধ্য হয়ে তাকে মাদামের নাতি চন্দ্রভূষণকে এই চিঠি লিখতে হচ্ছে। চন্দ্রভূষণ যদি আড়াই লাখ ফ্রাঁ অথবা তার সমমূল্যের ডলার, পাউন্ড কিংবা অন্য কোনও ইয়োরোপীয় মুদ্রার ব্যবস্থা করে দিতে পারেন, পত্রলেখক তা হলে রক্ষা পান। একই সঙ্গে, খুবই বিনীতভাবে হলেও, লুই আঁতোয়ান চন্দ্রভূষণকে এ-কথা জানিয়ে দিতে ভোলেননি যে, পিয়ের আঁতোয়ান মাদাম শান্তিলতাকে একটি উপহার দিয়েছিলেন, যে-উপহারের আর্থিক মূল্য আড়াই লাখ ফ্রার চেয়ে বেশি ছাড়া কম হবে না।
কথা শেষ করে পরমেশের দিকে তাকিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “কোন উপহারের কথা বলা হচ্ছে বুঝতে পারছ?”
পরমেশ প্রায় খাবি খাওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, “এই হিরেজোড়া?” ভাদুড়িমশাই মৃদু-মৃদু হাসছিলেন। বললেন, “তা-ই তো মনে হয়।”
“ওরে বাবা,” সদানন্দবাবু বললেন, “হরসূন্দর মুখুটি তো তা হলে মিচে কত কননি। কিন্তু একটা কতা তো মশাই আমি ঠিক বুজে উঠতে পারছি না।”
“কোন কথাটা?”
“লোকটা..মানে ওই পিয়ের তত ছিল গ্রেনাডিয়ার। হরসুন্দরবাবু অন্তত সেই কতাই বলেছেন। তার মানে তো সেরেফ একজন সোলজার। তা সোলজার হয়ে সে অত দামি হিরে পেল কোতায়? আর হ্যাঁ, পেলই বা কীভাবে?”
“সেটাও কিন্তু হরসুন্দরবাবুই বলেছেন।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “মানে সরাসরি বলা তো আর তার পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি কি গণতকার যে, অদ্দিন আগে কে কীভাবে একজোড়া হিরে জোগাড় করেছিল, খড়ি পেতে আঁক কষে সেটা বলে দেবেন। না মশাই, সেইভাবে তিনি কিছু বলেননি। তবে হ্যাঁ, একটা আন্দাজ দিয়েছিলেন ঠিকই।…তার শেষ কথাটা মনে নেই?”
“কী যেন একটা ডায়মন্ডের কথা বলেছিলেন।” কৌশিক বলল, “এও বলেছিলেন যে, সেটা ছিল চোরাই হিরে।”
“ঠিকই বলেছিলেন।”ভাদুড়িমশাই বললেন, “যে অলভ ডায়মন্ডের জগৎজোড়া খ্যাতি, সেটা তো এখন ক্রেমলিনে রয়েছে, কিন্তু এইটিনথ সেঞ্চুরিতে সেটা কোথায় ছিল জানিস?”
“কোথায় ছিল?”
“সাউথ ইন্ডিয়ার এক মন্দিরে। আদতে সেটাও ছিল বিগ্রহের চোখ। সেভেন্টিন ফিফটিতে সেটা চুরি হয়ে যায়। তাজ্জব ব্যাপার কী জানিস, সেটাও একজন ফ্রেঞ্চ সোলজারই চুরি করেছিল। এ-হাত সে-হাত ঘুরে সেটা কাউন্ট গ্রিগরি অর্লভের হাতে গিয়ে পৌঁছয়। বাস, সেই থেকে তার নাম হয়ে গেল অর্লভ ডায়মন্ড।