হরসুন্দর ভিতরে গিয়ে মিনিট তিন-চারের মধ্যেই ফিরে এলেন। হাত বাড়িয়ে ভাদুড়িমশাইয়ের হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “এই সেই চিঠি।… ক যা পাবার, এরই মধ্যে পেয়ে যাবেন। আর হ্যাঁ, চিঠিটা পড়তে পড়তে হয়তো অর্লভ ডায়মন্ডের কথা আপনাদের মনে পড়তে পারে। সেটা ছিল চোরাই হিরে।”
বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছি, হঠাৎ একটি অল্পবয়সী বউ একেবারে ঝড়ের মতো এসে হরসুন্দর মুখুটির বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ল। ঢুকেই তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, “ও দাদু, এ
কী সর্বনাশ করলেন আপনি?”
হরসুন্দর বাড়ির বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন। সেখান থেকেই হতভম্ব গলায় বললেন, “কেন, কী করেছি?”
“পটলার চুল কেটে দিলেন কেন?” কপাল চাপড়ে বউটি বলল, “ও তো মানতের চুল! সামনের জষ্টি মাসে যষ্ঠীতলায় গিয়ে ওর চুল ফেলার কথা! এ কী সর্বনাশ হল!”
.
॥ ৭ ॥
গলির পথটুকু তাড়াতাড়ি পেবিয়ে এসে গাড়িতে উঠে পড়লুম আম। ভাদুড়িমশাই সেলফের চাবি ঘুরিয়ে গাড়িতে স্টার্ট দিলেন। পরমেশ চৌধুরির বাড়িতে এসে পৌঁছনো পর্যন্ত পথে একটিও কথা হল না। বাড়িতে ঢুকে ভাদুড়িমশাই বললেন, “চিঠিখানা পড়তে হবে, এখন খানিকক্ষণ আমি একটু একলা থাকতে চাই। .. পরমেশ, তুমি এদের সঙ্গে বসে গল্প করো, আমি পাশের ঘরে আছি।”
ড্রয়িং রুমের লাগোয়া পুব দিকের ঘরটা ভাদুড়িমশাই আর কৌশিকের জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি সেখানে ঢুকে গেলেন
সদানন্দবাবু খুব বেশিক্ষণ কথা না বলে থাকতে পারেন না। এতক্ষণ তিনি একটাও কথা বলেননি। এইবারে কৌশিকের দিকে তাকিয়ে বললেন, “মানুষ বুড়ো হলে কী হয় বলে দিকি?”
কৌশিক বলল, “তা আমি কী করে বলব? আমি কি বুড়ো হয়েছি? ও-সব আপনারাই ভাল বুঝবেন।”
পরমেশ ক্লিষ্ট হেসে বললেন, “বুড়ো হলে বাতগ্রস্ত হয়।”
“আরে ধুর মশাই, সদানন্দবাবু বললেন, “আপনার কতা হচ্ছে না, আপনি, তো ছেলেমানুষ। কত বয়েস হল আপনার?”
“সিক্সটিটু।”
“ওটা কি একটা বয়েস হল নাকি? এই যে আমি সেভেন্টি পেরিয়ে এইচি, তাও নিজেকে বুড়ো ভাবি না। আমার ওয়াইফ অবিশ্যি গেঁটেবাতে একটু কাবু হয়ে পড়েছেন, কিন্তু আমি?” সদানন্দবাবু চেয়ার ছেড়ে তড়াক করে দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, “রোজ তিন মাইল মর্নিং ওয়াক করি।”
আমি বললুম, “ও নিয়ে এত জাঁক করবেন না। হরসূন্দরবাবুর বয়েস তো শুনলেন, বিরানব্বই, তা মর্নিং ওয়াক তো তিনিও নাকি করেন। বাতগ্রস্ত হতে পারতেন?”
কৌশিক বলল, “সত্যি, এত বয়েস ভদ্রলোকের, অথচ এখনও দিবি। সটান। ভাবা যায়? মেমারিও তো মনে হল ঠিকই আছে।”
“শুধু মেমারি কেন, পরমেশ বললেন, “চোখ, কান, নাক, সব ঠিক আছে। তা ছাড়া, দেখলেই তো, একেবারে ফোটোগ্রাফিক মেমারি। খাওয়া-দাওয়াও একদম স্বাভাবিক। বুড়ো হলে শুনেছি হজমশক্তি কমে যায়। ওঁর খাওয়া দেখে তা কিন্তু মনে হয় না। প্রতিটি নেমা অ্যাটেন্ড করেন, খানও পংক্তিভোজনে বসে…। না, এত যে বয়েস, হাঁটা-চলা খাওয়া-দাওয়া, কোনও কিছু দেখেই তা বুঝবার উপায় নেই।”
সদানন্দবাবু বললেন, “দাত দেকলুম একটাও নেই। বাঁদিয়ে নেন না কেন?”
“দরকার হয় না।” পরমেশ বললেন, “যে-লোক স্রেফ মাড়ি দিয়ে চিবিয়ে সজনে ডাটা ছিবড়ে করে ফেলতে পাবে, তার আবার নকল-দাঁতের দরকার কী…. তবে হ্যাঁ, বার্ধক্যের একটা লক্ষণ অবশ্য বছর খানেক হল দেখা দিয়েছে। পকেটে সব সময় একটা কঁচি নিয়ে ঘোরেন। রাস্তায় বেরিয়ে একবার দেখতে পেলেই হল যে, কোনও বাচ্চা ছেলেব চুল তার কাধ অব্দি নেমে এসেছে, বাস, কাঁক করে তাকে ধরে অমনি পকেট থেকে কাচি বার করে ঘাচ-গ্র্যাচ করে তার চুল কাটতে বসে যাবেন। তার ফলে কী হয়, সে তো আপনারা একটু আগেই আজ দেখলেন। মানতেব চুল কেটে ফেলেছে, বাচ্চাটার মা কি ওঁকে সহজে ছেড়ে দেবে?”
কৌশিক বলল, “বাতিকগ্রস্ত আর কাকে বলে!”
সদানন্দবাবু বললেন, “আমার পিসশ্বশুরের সঙ্গে হরসূন্দরবাবুব খুব মিল আচে দেকচি। বুড়ো বয়সে তিনিও তার ফতুয়ার পকেটে কঁচি নিয়ে ঘুরতেন।”
“বলেন কী, কৌশিক আঁতকে উঠে বলল, “তিনিও বাচ্চা-ছেলেদের ধরে চুল কেটে দিতেন?”
‘না, চুল নয়… মানে চুলই, তবে গোটা মাতার চুল নয়, সদানন্দবাবু বললেন, “শুদু টিকি। একবার তো সরস্বতী পুজোর দিনে, গুটিগুটি পেছন দিক থেকে গিয়ে, ঘ্যাঁচ করে এক পুরুতঠাকুরের টিকি কেটে দিয়েছিলেন।”
“অ্যাঁ, বলেন কী?”
“সে মানে কেলেঙ্কারির একশেষ! পুরুতঠাকুর তো হাপুস নয়নে কাঁদতে লাগলেন। কাঁদেন আর বলেন যে, তার মিনস অফ লাইভলিহুডই চলে গেল। যে পুরুতের টিকিই নেই, কে তাকে পুজো করতে ডাকবে!…তো শেষ পর্যন্ত কী হল জানেন?”
পরমেশ বললেন, “কী হল?”
“পিসতুতো শালাকে নগদ ফিফটি রুপিজ দিয়ে ব্যাপারটা মেটাতে হল।” সদানন্দবাবু বললেন, “আজ যা কাণ্ড দেকলুম, তাতে মনে হচ্চে হরসুন্দরবাবুকেও তার গাঁট থেকে কিছু খসাতে হবে। মানতের চুল কেটেচেন, তার দণ্ড দিতে হবে না?”
আমি বললুম, “পাড়ার ছেলেরা ওঁর পিছনে লাগে না?”
“লাগে বই কী, পরমেশ বললেন, “আড়ালে-আবডালে বলে, হরসুন্দর না নরসুন্দর!”
সদানন্দবাবু বললেন, “তাও তো আমার বাবার এক মামাতো ভাইয়ের কতা এখনও বলিনি। তিনি ছিলেন…”
তিনি যে কী ছিলেন, তা আর শোনা হল না, কেন না ঠিক সেই মুহূর্তেই পাশের ঘর থেকে ভাদুড়িমশাই বেরিয়ে এসে, হরসুন্দরবাবুর কাছ থেকে সংগৃহীত চিঠিখানা পরমেশবাবুর দিকে এগিয়ে ধরে বললেন, “তুমি তো ফরাসি জানো, চিঠিখানা পড়ে দ্যাখো তো কী মনে হয়।”