হরসূন্দর বললেন, “বলছি, বলছি। হিরে দুটো কোত্থেকে কীভাবে এল, তা তো আমাকে বলতেই হবে। তার প্রমাণও আমার কাছে রয়েছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, প্রমাণটাই বা আমার হাতে এল কীভাবে। আপনারা কি কালীভূষণের কথা কিছু জানেন?”
“এইটুকু জানি যে, তিনি বিত্তশালী মানুষ ছিলেন। ভাদুড়িমশাই বললেন, “শুনেছি যে, ওই মন্দিরের তিনিই প্রতিষ্ঠাতা। এও শুনেছি যে, তিনি গঙ্গাস্নান করতে গিয়ে জলে ডুবে মারা যান।”
“ঠিকই শুনেছেন। তবে ওই মারা যাওয়াটা নেহাতই দুর্ঘটনা, না আত্মহত্যা, তাই নিয়ে সেকালে কিছু মতভেদ ছিল বলে আমার বাপ-ঠাকুর কাছে শুনেছি। সে যা-ই হোক, কালীভূষণ যে ফরাসিটা খুব ভাল জানতেন, এটা আপনারা শুনেছেন?”
‘না। তবে জানাই তো স্বাভাবিক।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “ফরাসি এলাকায় থাকতেন, ফরাসি অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের আনুকূল্যে নিজের বিত্তসম্পদ যথাসম্ভব বাড়িয়ে নিয়েছিলেন, তাদের মন জুগিয়ে চলতে হত, তাদের ভাষাটা না জানলে চলে?”
“সে তো ঠিক,” হরসুন্দর হেসে বললেন, “ফরাসিদের সঙ্গে যার কাজ-কারবার, মেলামেশা, ওঠাবসা, ফরাসি ভাষায় তাকে দুরস্ত হতে হবে বই কী। কিন্তু না, কথাটা তো তা নয়।”
“কথাট। তা হলে কী?”
“কথাটা এই যে, কালীভূষণকে তো তার নিজের স্বার্থে …মানে নিজের কাজ কারবারের স্বার্থে ফরাসিতে দুরস্ত হতে হয়েছিল। কিন্তু তার স্ত্রীকে তাই বলে ফবাসি শেখাবার দরকার হল কেন?”
“বটে?” ভাদুড়িমশাই বললেন, “শান্তিলতাও ফরাসি জানতেন নাকি?”
“নামটাও জানেন দেখছি।”
“হ্যাঁ, জানি।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “বিমলভূষণের কাছে শুনেছিলুম। সেনেদের বাড়ির বিমলভূষণকে তো আপনি ভালই চেনেন?”
“তা চিনি বই কী।” হরসুন্দর তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন, “ওটা না-শিখেছে ফরাসি, না-শিখেছে ইংরেজি। বাংলাটাও ঠিকমতো শিখেছে কি না, তাতে আমার সন্দেহ আছে। ওটা একটা গাধা। ওর বাবা চন্দ্রভূষণ ছিল আমার ছেলেবেলার বন্ধু। তবে সেটাও ছিল একটা গাধা। লেখাপড়ায় ডডনং। ফরাসিদের একোলে পড়ত, কিন্তু ক্লাস ফোর
থেকে ফাইভে উঠতেই বার তিনেক তার প্রোমোশন আটকে যায়। ভাবতে পারেন?”
সদানন্দবাবু বললেন, “একোলটা কী জিনিস।“
“ইস্কুল।” হরসুন্দর বললেন, “কিন্তু যা বলছিলাম। কালীভূষণের পরে ও-বাড়িতে আর লেখাপড়ার চর্চা হয়নি। ওরা না জানে ফরাসি, না জানে ইংরেজি।” একটুক্ষণের জন্যে চুপ করলেন হরসুন্দর। তারপর বললেন, “কীর্তিভূষণ সম্পর্কে শুনেছি, তিনি তবু তাঁর মায়ের চাপে পড়ে একটু-আধটু ফরাসি শিখেছিলেন। কিন্তু চন্দ্রভূষণ তো আ-বে-সে দে’র পরে আর কিছুই শেখেনি। আরে মশাই, ফরাসি জানলে কি আর ফ্রান্স থেকে লেখা একখানা চিঠি পড়াবার জন্যে তাকে আমার কাছে ছুটে আসতে হত। আর সেই চিঠি না পড়লে কি আমিই জানতে পারতুম যে, ওদের হিরে দুটো কোত্থেকে কীভাবে এসেছিল?”
ভাদুড়িমশাইয়ের চোখ দুটো দেখলুম হঠাৎই সরু হয়ে এসেছে। বললেন, “চিঠিখানা কোথায়?”
“আমারই কাছে আছে। তবে কাউকে দেখাইনি। কথা ছিল, চিঠিখানা পড়ে বাংলায় আমি তার তর্জমা করে রাখব, চন্দ্রভূষণ তার পরদিন এসে তর্জমা আর মূল চিঠি আমার কাছ থেকে নিয়ে যাবে। কিন্তু তা আব সে নিতে পারেনি। সেই রাত্তিরেই বাড়িতে ফিরে তার জ্বর আসে। কী জ্বর তা বোঝা গেল না। তিন দিনের মধ্যে চন্দ্র মারা গেল।”
“এটা কবেকার কথা?”
“নাইনটিন সেভেন্টির। তার মানে প্রায় তিরিশ বছর আগেকার।”
“চিঠিখানা দেখা যায়?”
“স্বচ্ছন্দে।” হরসুন্দর বললেন, “চান তো সঙ্গে করে নিয়েও যেতে পারেন। তবে কিনা ফেরত চাই। ফরাসি ভাষায় চন্দননগরের একটা ইতিহাস লিখছি কিনা, ডকুমেন্টারি এভিডেন্স হিসেবে ওটা কাজে লাগবে।”
চিঠি সম্পর্কে তক্ষুনি আর-কিছু বললেন না ভাদুড়িমশাই। প্রসঙ্গ পালটে বললেন, “শান্তিলতাকে ফরাসি শেখাবার কথা হচ্ছিল। তা এতে তো আমি অস্বাভাবিক কিছু দেখছি না। কালীভূষণের সঙ্গে তখনকার ফরাসি কর্তাদের যে দহরম-মহরমের কথা শুনেছি, তাতে তো মনে হয়, তাদের দেওয়া পার্টি-টার্টিতেও তাকে যেতে হত। মিল্ড পার্টি হলে গিন্নিকেও হয়তো নিয়ে যেতেন..। মানে সেটাই তো স্বাভাবিক। আর গিন্নি যদি যানই, তো ভাষা না জানার দরুন সেখানে গিয়ে তিনি বোবা হয়ে বসে থাকবেন, তা তো হয় না। তা সে যা-ই হোক, ফরাসিটা তিনি শিখলেন কোথায়? এখানকারই কোনও ইস্কুলে, না তার স্বামীর কাছে?”
হরসুন্দর হেসে বললেন, “পার্টি-টাটির কোনও কথাই উঠছে না, এমনকী ইস্কুলেরও না। আমার ঠাকুমার কাছে শুনেছি যে, শান্তিলতা ছিলেন…. ওই যাকে ঘোর পর্দানশিন মহিলা বলে, তা-ই। আর তার স্বামী? যে-লোককে সম্পত্তি বাড়ানোর কাজেই অষ্টপ্রহর ব্যস্ত থাকতে হয়, স্ত্রীকে ফরাসি শেখাবার সময় কোথায় তার?”
“তা হলে তিনি ফরাসিটা শিখলেন কোথায়?”
“সেই কথাই তো বলছি।” হরসুন্দর আবার নিঃশব্দ হাসতে শুরু করলেন। তারপর বললেন, “টাকাপয়সার তো অভাব নেই, স্ত্রীকে ফরাসি শেখাবার জন্যে কালীভূষণ তার বাড়িতেই একজন টিউটর রেখে দিলেন।”
“লোকটা ফরাসি?”
“অবশ্য। লোকটা গ্রেনাডিয়ার হয়ে এসেছিল, কিন্তু শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্যে ফ্রেঞ্চ আর্মি থেকে তার চাকরি যায়। তখন কালীভূষণ তাকে বাড়িতে আশ্রয় দেন। আর এতকাল যাঁকে বন্ধ্যা ভাবা হয়েছিল, সেই শান্তিলতা সন্তানসম্ভবা হন। …তো যা বুঝবার, এর থেকেই বুঝে নিন আপনারা। বাকি যা বুঝবার, চিঠিটা পড়লেই বুঝতে পারবেন। আমি বরং চিঠিটা নিয়ে আসি।”