“তা লাগে না বটে!”
“তো সেইভাবে একটা থিয়োরি আমি দাঁড় করিয়েছি।” হরসুন্দর বললেন, “তার খানিক-খানিক অবশ্য গেস্-ওয়ার্ক। বিশেষ করে কালীভূষণের মৃত্যুর ব্যাপারটা।”
“বেশ তো, সেটাই বলুন।”
“খোলাখুলি বলব না, শুধু কু ধরিয়ে দেব। কিন্তু তার আগে দুটো কথা আপনাদের মনে রাখতে হবে। শ্যারশে লা ফাম বলে একটা প্রবাদবাক্য আছে জানেন তো?”
“জানি।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “ওটা ফরাসি প্রোভার্ব। এর অর্থ হচ্ছে মেয়েটাকে খুঁজে বার করুন। মানে, ধরেই নেওয়া হয় যে, তাবৎ জটিল রহস্যের মূলে রয়েছে কোনও মেয়ে। রহস্যের কিনারা করতে হলে সেই মেয়েটাকে খুঁজে বার করা চাই।”
হরসুন্দর বললেন, “কারেক্ট। কিন্তু শুধু এই কথাটা জানলেই তো হবে না। মনে রাখতে হবে আর-একটা কথাও।”
“সেটা কী?”
“ফাম ফাতাল কথাটা কখনও শুনেছেন?”
“শুনেছি। এটাও ফরাসি কথা।”
“অর্থ জানেন?”
“জানি। ইংরেজিতে এর অর্থ হল ফেটাল উয়োম্যান। সংস্কৃতে ওই যে বিষকন্যা বলে একটা কথা আছে, এ হল তা-ই। বাংলায় বলতে পারি; সর্বনাশা মেয়ে। যাব ঘাড়ে চাপে, তার সর্বনাশ করে ছাড়ে। …কিন্তু ব্যাপারটা কী মুখুটিমশাই? আপনি কি আমার ফরাসি বিদ্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন নাকি?”
হরসুন্দর মুখুটি এতক্ষণ নিঃশব্দে হাসছিলেন। এবারে শব্দ করে হাসলেন। তারপর হাসি থামিয়ে বললেন, “আরে না। এককালে যে এখানে ফরাসি বিদ্যের বেশ ভালরকম চর্চা হত, যেমন পণ্ডিচেরিতে তেমনি এখানে..মানে ভদ্রেশ্বরে নয়, চন্নননগরে সেটা জানেন তো?”
“তা কেন জানব না?” ভাদুড়িমশাই বললেন, “ফরাসি কলোনি, সেখানে ফরাসি ল্যাংগুয়েজ অ্যান্ড লিটারেচারের চর্চা হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক।”
“ঠিক কথা। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, যারাই চননগরের বাসিদে, তারাই ফরাসিতে এক-একজন মস্ত পণ্ডিত। আবার ফরাসি কলোনির বাইরের লোক হলেই যে সে ফরাসি ভাষা জানবে না, তাও কিন্তু নয়।“
আলোচনা যে কোন দিকে যাচ্ছে, আমরা কেউই তা ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তবে হরসুন্দরের প্রতিটি কথাতেই আমরা মাথা নেড়ে সায় দিয়ে যাচ্ছিলুম। সদানন্দবাবু অবশ্য শুধু মাথা নেড়েই ক্ষান্ত থাকার পাত্র নন। মাথা নাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে তিনি মাঝে-মাঝেই বলছিলেন, “তা তো বটেই, তা তো বটেই।”
হরসুন্দর হয়তো সেই কারণেই ধরে নিয়ে থাকবেন যে, আমাদের মধ্যে সদানন্দবাবুই তার কথাবার্তার সবচেয়ে বড় বোদ্ধা। সরাসরি এবারে সদানন্দবাবুর দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, “এই আমার কথাই ধরুন। আমি ভদ্রেশ্বরের লোক, কিন্তু ফরাসিটা আমি যে শুধু বুঝতে পারি, পড়তে পারি আর বলতে পারি, তা নয়, ওতে আমি যেমন আমার অটোবায়োগ্রাফি আর একখানা নাটক, তেমনি তিন-তিনখানা উপন্যাসও লিখে ফেলেছি।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “ছেপে বেরিয়েছে?”
“এখনও বেরোয়নি।” হরসুন্দর বললেন, “আশে কোম্পানির নাম শুনেছেন? ইংরেজরা ওই যাকে হ্যাঁচেট বলে আর কি। শুনেছেন?”
“তা কেন শুনব না? ডাকসাইটে ফ্রেঞ্চ পাবলিশার।”
“ঠিক বলেছেন। তো তাদের কাছে ম্যানাসক্রিপট পাঠিয়ে দিয়েছি। তারা পড়ে দেখছে। ছাপবে নিশ্চয়।”
ভদ্রলোক আরও কিছু বলতেন হয়তো, কিন্তু যে মেয়েটি চা দিয়ে গিয়েছিল, সে এই সময়ে ফের ঘরে ঢুকে বলল, “দাদু, তোমার বেড়াতে যাবার সময় হয়েছে। লাঠিটা এনে দেব?”
“আজ একটু পরে বেরোব।” হরসুন্দর বললেন, “কাপগুলো নিয়ে যা।” শূন্য পেয়ালাগুলিকে থালায় তুলে নিয়ে মেয়েটি নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
ভদ্রলোকের বেড়াতে যাবার সময় হয়েছে শুনে আমরাও উঠে পড়তে যাচ্ছিলুম, কিন্তু হরসুন্দরই আমাদের বাধা দিয়ে বললেন, “আরে বসুন, বসুন, আসল কথাটাই তো এখনও বলিনি।…ও হ্যাঁ, কী বলছিলাম যেন?”
সদানন্দবাবু বললেন, “আপনার বই ছাপার কথা।”
“না, না, ওটা নয়। তার আগে কী বলছিলাম?”
পরমেশ বললেন, “বলছিলেন যে, আমরা চননগরের লোকেরাও সবাই ফরাসি জানি না, আবার আপনি ভদ্রেশ্বরের লোক হয়েও…”
কথাটা শেষ করতে দিলেন না হরসুন্দর। বললেন, “ঠিক ঠিক। আমি যা ফরাসি জানি, তোমাদের অনেকেই তার সিকির সিকিও জানো না।…কী, বিশ্বাস হচ্ছে না? বেশ, তা হলে ওই সেনেদের কথাই ধরো।”
বলেই হঠাৎ ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকালেন হরসুন্দর মুখুটি। বললেন, “ও মশাই, ওই সেনেদের বাড়ি নিয়েই তো কথা হচ্ছিল, তাই না?”
“হ্যাঁ,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “টু বি প্রিসাইজ, ওদের হরপার্বতীর চোখের হিরে নিয়ে।”
“ঠিক হিরে নিয়েও নয়, হিরে দুটো কী করে ওদের হাতে এল, তা-ই নিয়ে। কিন্তু আমিই বা সে-কথা জানলুম কী করে? আরে মশাই, আমিও জানতে পারতাম না, কালীভূষণের ধারাটা যদি ওবাড়িতে বজায় থাকত।..কী, এর থেকে কিছু বুঝলেন?”
কিছুই বুঝলুম না। অন্যদের দিকে তাকিয়ে মনে হল, তারাও কিছুই বোঝেননি। একা সদানন্দবাবুই শুধু মুখে একটা বুঝি-বুঝি ভাব জাগিয়ে রেখে মৃদু-মৃদু হাস্য করছেন।
ওই হাসিটাই তাঁর বিপদ ঘটাল। হরসুন্দর সরাসরি তার দিকে তাকিয়ে বললেন, “যাক, আপনি অন্তত বুঝেছেন।”
হাসিটা একেবারে সঙ্গে-সঙ্গেই সদানন্দবাবুর মুখ থেকে মুছে গেল। কাতর গলায় তিনি বললেন, “আজ্ঞে না।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “দেখুন হরসুন্দরবাবু, এর মধ্যে যে একজন মহিলা জড়িয়ে আছে, সেটা আমি আগেই আন্দাজ করেছিলুম। সম্ভবত তিনি বিমলভূষণের প্রপিতামহী শান্তিলতা দেবী। কিন্তু কালীভূষণের ধারা’ বলতে যে আপনি কী বোঝাতে চাইছেন, সেটা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। একটু যদি বুঝিয়ে বলেন তো বড্ড ভাল হয়।”