পরমেশ বললেন, “চুল কেটে দিয়েছেন তো?”
“তা আর বলতে! একেবারে উঁদি ঘেঁষে হেঁটে দিয়েছি। বুঝলে হে পরমেশ…” কথাটা শেষ করলেন না। একেবারে হঠাৎই আমাদের দিকে চোখ পড়ল হরসুন্দর মুখুটির। বললেন, “এরা কারা?”
“কলকাতার লোক। আমার বন্ধু। আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।”
“আমার সঙ্গে?” হরসুন্দর বললেন, “কেন?”
“সেনেদের হরপার্বতীর হিরের চোখ নিয়ে কথা বলতে চান।”
বছর পনবো-ষোলোর একটি শ্যামলা রোগা মেয়ে মস্ত একটা কঁসার থালার উপরে ছকাপ চা আর একটা প্লেটে কিছু বিস্কুট সাজিয়ে নিয়ে ঘরে ঢুকে তক্তপোশেরই একদিকে থালাটা রেখে নিঃশব্দে আবার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। হরসুন্দর বললেন, “আগে চা খান, পরে কথা হবে।”
আমি আর সদানন্দবাবু সাধারণত দুধচিনি মেশানে! চা খাই না। এক্ষেত্রে মুখ বুজে খেয়ে নিলুম। দুধটা সম্ভবত ঠাণ্ডা ছিল, ফলে চাটাও একটু ঠাণ্ডা মেরে গেছে, খেতে তাই বিশেষ সময়ও লাগল না। চটপট চা খেয়ে যে-যার পেয়ালা থালায় নামিয়ে রাখলুম। হরসুন্দর মুখুটি কিন্তু সেই ঠাণ্ডা চাই বেশ সময় নিয়ে তারিয়ে তারিয়ে গেলেন। তারপর তিনিও তার পেয়ালাটিকে থালায় নামিয়ে রেখে বললেন, “আপনারা ঠিক কী জানতে চান বলুন দিকি।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “দামের কথাটা জানতে চাই।”
শুনে যেন ভারি অবাক হয়ে গেছেন এইভাবে হরসুন্দর খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে। তারপর বললেন, “কীসের দাম?”
পরমেশ বললেন, “সে কী হরসুন্দরকাকা, সেনেদের হরপার্বতীর থার্ড আইতে হিরে পরানো আছে না?”
“তা আছে বই কী।” হবসূদর বললেন, “তবে সম্বচ্ছর পরানো থাকে না, ওই শুধু চোত সংক্রান্তির দিনে পবিয়ে পরদিনই আবার খুলে নেওয়া হয়। কেন, তাতে হয়েছেটা কী?”
“খেলে যা!” পরমেশবাবু নিচু গলায় বললেন, “বুড়ো দেখছি ব্যাপারটা ঠিক ধরতেই পারছে না!”
কিন্তু, যত নিচু গলাতেই বলা হোক না কেন, হসূদবের কানে দেখলুম কথাটা ঠিকই পৌঁছে গেছে। শুনে রেগে যাওয়াটা স্বাভাবিক হত। কিন্তু তিনি রেগে গেলেন না, হেসে, একটা চোখ একটু ছোট করে বললেন, “তা হলে আর এই বুড়োর কাছে এসেছ কেন? ওই বিমলভূষণের কাছেই যাও, জোড়া হিরে নিয়ে ওর বাপ-ঠাকুর্দা যা বলত, আর ও নিজেও শুনি যা বলে বেড়াচ্ছে, সেই গপ্পোটাই শোনো গিয়ে।”
উত্তরে পরমেশ কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ভাদুড়িমশাই তাকে বলতে দিলেন না। হাতের ইঙ্গিতে তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “গপ্পা কি না জানি না, তবে বিমলভূষণের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। হিরের ব্যাপারে তাঁর যে বক্তব্য, তাও শুনেছি। শুনে বিশ্বাসও করিনি, অবিশ্বাসও করিনি। পুরোপুরি বিশ্বাসই যদি করব, তবে সেটা আবার আপনার কাছে যাচাই করতে আসব কেন?”
কথাটা শুনে স্পষ্টতই খুশি হলেন হরসুন্দর মুখুটি। বললেন, “এসে ভাল করেছেন। এ ব্যাপারে আমি যা জানি, তা আপনাকে বলব বই কী, নিশ্চয় বলব। কিন্তু তার আগে শুনতে চাই যে, বিমল কী বলেছে। বলেনি যে, এক গুজরাটি ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ওর ঠাকুর্দার বাপ ওটা কিনেছিল?”
“হ্যাঁ, তা-ই বলেছিলেন বটে।”
“বাজে কথা।”
“তার মানে ওই হিরে দুটো এক গুজরাটি ব্যবসায়ীর কাছ থেকে কেনা হয়নি?”
হরসুন্দরের মুখে দেখলুম হাসির রেখা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। গালের চামড়া অল্প অল্প কঁপতে শুরু করেছে। মিনিট খানেক একেবারে নিঃশব্দে হেসে নিলেন তিনি। তারপর বললেন, “একটা সত্যিকথাকে চেপে রাখার জন্যে কত মিথ্যে কথাই না লোকে বলতে পারে। কোন মানে হয়?”
“সত্যি কথাটা কী?”
“সত্যি কথাটা এই যে, কোনও গুজরাটি ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ওই হিরে কেনা হয়নি।”
“তা হলে কার কাছ থেকে কেনা হয়েছে?”
আবার এক প্রস্ত হেসে নিলেন হরসুন্দর। এবারও সেই আগের মতোই নিঃশব্দে। তারপর বললেন, “কিনতে হবে কেন? ওই হিরে দুটো আদৌ কেনা হয়নি।”
সদানন্দবাবু অনেকক্ষণ কোনও কথা বলেননি। কিন্তু এরপরে আর তাকে ঠেকিয়ে রাখা গেল না। সামনের দিকে মাথাটা একটু ঝুঁকিয়ে, ফিসফিস করে বললেন, “চোরাই মাল?”
“হতেই পারে। তবে কালীভূষণ চুরি করেননি।” হরসুন্দর বললেন, “আগের কথা জানি না, তবে এক্ষেত্রে ও দুটো চুরিও করা হয়নি, ডাকাতিও করা হয়নি।”
“তা কী করে হয়?” কৌশিক বলল, “আপনি বলছেন, এক্ষেত্রে ও দুটো কেনা হয়নি, আবার চুরি-ডাকাতিও করা হয়নি। হিরে দুটো কি তা হলে আপসে এসে গেল? তাও আবার হয় নাকি?”
“হবে না কেন, হয়।” কৌশিকের দিকে তাকিয়ে হরসুন্দর মুখুটি বললেন, “কিন্তু কী করে হয়, তুমি তো নেহাতই ছেলেমানুষ, তুমি সে কথা বুঝবে না।”
.
॥ ৬ ॥
ভাদুড়িমশাই বললেন, “মহিলাটি কে?”
চকিতে কৌশিকের দিক থেকে ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে মুখ ফেরালেন হরসুন্দর মুখুটি। দুই চোখের ধবধবে সাদা ভুরু দুটি একেবারে হঠাৎই তাদের স্বাভাবিক জায়গা থেকে আধ-ইঞ্চি উর্ধ্বে উঠে গেল। গলা ঈষৎ নামিয়ে তিনি বললেন, “ধরতে পেরেছেন দেখছি।”
ভাদুড়িমশাই সামান্য হেসে বললেন, “ঠিক যে ধরতে পেরেছি তা বলব না। তবে হ্যাঁ, আন্দাজ করেছি। কিন্তু আন্দাজ দিয়ে তো কাজ চলে না, আপনার কাছে সবটা জানতে চাই।”
“আমিও কি আর তেমনভাবে জানি যে, সাক্ষ্যপ্রমাণ সাজিয়ে সব বলব?” হরসুন্দর বললেন, “না মশাই, তা আমি জানি না। পাথুরে কোনও প্রমাণও আমি দাখিল করতে পারব না। তবে হ্যাঁ, দুয়ে-দুয়ে যে চার হয়, তার কি কোনও প্রমাণ লাগে?”