ভাদুড়িমশাই বললেন, “তুমি কিছু বলার আগে বরং আমি একটা কথা জিজ্ঞেস করব।”
“বেশ ভো, করো।”
“ভদ্রলোকের বয়েস তো শুনলুম বিরানব্বই। বাড়িয়ে বলোনি তো?”
“আরে না, পরমেশ চৌধুরি হেসে বললেন, “দু’বছর আগে ওঁর নব্বই বছর পূর্তি উপলক্ষে আমরাই স্ট্র্যান্ড ওয়াকার্স অ্যাসোসিয়েশন থেকে ওঁকে একটা সম্বর্ধনা দিয়েছিলুম। আগে দু’বেলা স্ট্র্যান্ডে গিয়ে হাঁটতেন, এখন শুধু সকালে হাঁটেন।”
“তা হাঁটুন, কিন্তু অন্য সব ফ্যাকাল্টি ঠিক আছে তো?”
“তার মানে?”
“তার মানে চোখে ঠিকমতো দেখতে পান কি না, কানে ঠিকমতো শুনতে পান কি না, মেমারি ঠিকমতো কাজ করছে কি না, এই আর কি।”
সদানন্দবাবু মুরুব্বির চালে বলেন, “এই বয়েসে অনেকেরই ও-সব গুবলেট হয়ে যায় তো! তবে হ্যাঁ, আমার মনে হয়, এনার বেলায় তা হয়নি, সব ঠিক আছে।”
পরমেশবাবুর সঙ্গে কথা বলছিলেন ভাদুড়িমশাই। তাঁর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে সদানন্দবাবুর দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে বললেন, “আপনি কী করে জানলেন? চেনেন নাকি?”
কোঁচকানো ভুরু দেখেই সদানন্দবাবু সম্ভবত একটু অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করেছিলেন। আমতা-আমতা করে বললেন, “না…মানে ঠিক যে চিনি তা নয়। তবে কিনা…ওই মানে…।”
“ওই মানে কী?”
“ওই মানে ভাবছিলুম যে, মর্নিং ওয়াক করেন তো, তাই নিশ্চয় শরীরের কলকজাগুলো বিগড়ে যায়নি।”
“বাস,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “তাই থেকেই আপনি বুঝে গেলেন যে, লোকটার ফ্যাকালটিগুলো সব ঠিক আছে? ধন্যি লোক আপনি!”
ভাদুড়িমশাই আরও দু’একটা কথা বলতেন হয়তো, কিন্তু পরমেশবাবু তাকে বাধা দিয়ে বললেন, “না চারুদা, উনি ঠিকই বলেছেন। হরসুন্দরবাবু কানেও ঠিকই শুনতে পান, চোখেও ঠিকই দেখতে পান। আর হ্যাঁ, মেমারির কথা বলছিলে তো, হি হ্যাঁজ এ ফোটোগ্রাফিক মেমারি। জগদ্ধাত্রী পুজোর বিসর্জনের দিন কবে কোন ঠাকুরের হাইট নিয়ে গণ্ডগোল বেধেছিল, সেটা কোন ক্লাবের ঠাকুর, শেষ পর্যন্ত গণ্ডগোল কীভাবে মেটানো হয়, সব একেবারে গড়গড় করে বলে দেবেন। কিছু ভোলননি। রিমার্কেল স্মৃতি। তবে সেটা মর্নিং ওয়াকের জন্য হয়েছে কি না, তা বলতে পারব না।”
“বাঃ, তবে তো ভালই হল!” ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা হলে আর দেরি করা কেন। চলো, এগোনো যাক।”
স্যাঁতাপড়া এঁদো গলি, বাড়িগুলির বেশির ভাগই একতলা, বাইরের দেওয়ালের পলেস্তারা খসে পড়েছে, ইটগুলো দাঁত বার করে আছে, এ-সব বাড়ির কোনওটারই বয়েস নেহাত কম হবে না। খানিকটা এগোনোর পর তারই একটার সামনে দাঁড়িয়ে পরমেশ বললেন, “এই বাড়ি। হুটোপাটির শব্দ শুনে মনে হচ্ছে, হরসুন্দরকাকা আবার কাউকে নিয়ে পড়েছেন।”
কাকে নিয়ে পড়েছেন, ভেজানো সদর দরজা ঠেলে ভিতরের উঠোনে ঢুকেই সেটা বোঝা গেল। মাথায় ঝাঁকড়া-চুলওয়ালা বছর ছয়-সাতের উদোম একটা রোগা ডিগডিগে ছেলে উঠোনের মাঝখানকার তুলসী-মঞ্চ ঘিরে দু’হাতে নিজের লজ্জাস্থান ঢেকে পরিত্রাহি চেঁচাতে চেঁচাতে দৌড়চ্ছে, আব হাতে একটা কাচি নিয়ে তার পেছাপেছন দৌড়চ্ছেন এক বৃদ্ধ। কাণ্ড দেখে আমরা যে একটু হকচকিয়ে গিয়েছিলাম, সেটা স্বীকার করাই ভাল। পরমেশ চৌধুরির কথা আলাদা, তিনি সম্ভবত এই ধরনের দৃশ্য মাঝে-মাঝেই দেখে থাকেন, কিন্তু আমরা কেউই এর জন্যে ঠিক প্রস্তুত ছিলাম না। উলঙ্গ অবস্থায় বাইরের লোজনদের সামনে পড়ে গিয়ে বাচ্চা ছেলেটিও নিশ্চয় এক মুহূর্তের জন্য ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল। সেটা কাটিয়ে ওঠার আগেই বুড়ো মানুষটি খপ করে তার একটা হাত ধরে ফেলে হাঁক পাড়লেন, “রোঘা!”
হাঁক শুনে যাই দাদু’ বলে যে ছোকরা মতন ছেলেটি ভিতর বাড়ি থেকে বাইরে বেরিয়ে এল, তার বয়েস বছর উনিশ-কুড়ির বেশি হবে না। বেরিয়েই আমাদের দেখে সে অবাক। তারপর পরমেশবাবুর ওপর চোখ পড়তে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, “ও দাদু, পরমেশ জ্যাঠামশাই এসেছে।”
বৃদ্ধ যে তাই এনে বাচ্চা ছেলেটিকে ছেড়ে দিলেন, তা নয়। যে-ভাবে তার হাতটাকে ধরে রেখেছিলেন, সেইভাবে ধরে বেখে, আমাদের দিকে চোখ না ফিরিয়েই বললেন, “ওহে পরমেশ, দেখতেই পাচ্ছ যে, আমি এই বাদবটাকে নিয়ে ব্যস্ত আছি। তুমি বরং বাইরের ঘরে বসে একটু অপেক্ষা করো, আমি আমার হাতের কাজটা সেবে নিই, তারপর তোমার সঙ্গে কথা বলব অখন।”
বোঘে, যার নাম সম্ভবত রঘুনাথ কি রঘুবীর, আমাদের যে ঘরটিতে নিয়ে বসাল, তার একদিকে সূক্তনি-ঢাকা একটি তক্তপোশ, অন্যদিকে খান দুয়েক টিনের চেয়ার। আমাদের বসিয়ে মাথার উপরের ফ্যান চালিয়ে দিয়ে রোঘো বলল, “আপনারা একটু বসুন, দাদু এক্ষুনি এসে পড়বেন।”
পরমেশ বললেন, “ওটি কার ছেলে? মনুর?”
“না, না,” বোঘঘা হেসে বলল, “দাদার নয়। আসলে এই বাড়িরই নয়। এটি আমাদের পাশেরও পাশের বাড়ির। দত্তবাড়ির হারুদাকে চেনেন তো? ওই যে হেভি অ্যাকটিং করে? তার ছোট ছেলে।”
রোঘো বিদায় নিল। যাবার আগে বলে গেল, “আপনারা বসুন, আমি চা পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
চা আসার আগেই হরসুন্দর মুখুটি ঘরে এসে ঢুকলেন। বললেন, “পুরো এক হপ্তা ধরে তক্কেতক্কে ছিলুম, কিন্তু কিছুতেই ধরতে পারছিলুম না। বাঁদরটা আমাকে দেখতে পেলেই ছিটকে পালাত। কিন্তু আমসত্ত্বের লোভ আছে না? মনুর বউয়ের কাছে আমসত্ত্ব চাইতে বোজ এই বাড়িতে আসে তো। বাস, আজ আসতেই কাঁক করে চেপে ধরেছি।”