“আর এই বাড়ি?” পরমেশ প্রায় আঁতকে উঠে বললেন, “এই বাড়ির কী হবে?”
“বিক্রি করে দেবে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “যেমন ভিন্টেজ কার, তেমনি ভিন্টেজ বাড়িরও আজকাল খুব কদর। খদ্দেরের অভাব হবে না।”
শুনে হাঁ করে খানিকক্ষণ ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন পরমেশ চৌধুরি। তারপর সামনের দিকে আঙুল তুলে বললেন, “ওই গাছটা দেখছ?”
“দেখছি। ওটা জাকারান্ডা গাছ। কলকাতায় বিডন স্কোয়ারের উত্তর-পশ্চিম কোণে একটা আছে। আর একটা দেখেছি ভি. আই. পি. রোডের ধারে। দিল্লিতে হেলি রোডে বঙ্গভবনের কাছেও একটা দেখেছি। ওটা দক্ষিণ আফ্রিকার গাছ।…গুঁড়ি দেখে মনে হচে, বয়েস নেহাত কম হল না।”
‘নব্বুই চলছে।” পরমেশ বললেন, “শুধু দক্ষিণ আফ্রিকায় কেন, আফ্রিকার আরও কয়েকটা জায়গায় হয়। যেমন ধরো মিড়ল কঙ্গোয়। এককালে যেটা ছিল ফ্রেঞ্চ কলোনি। তো আমার ঠাকুর্দা তো এখানকার ফরাসি সরকারের কাজ করতেন। তার ওপরওয়ালা কঙ্গো থেকে এখানে বদলি হয়ে আসার সময় সঙ্গে করে কারান্ডার গুটিকয়েক চারা নিয়ে। এসেছিলেন। তার থেকে একটা তিনি ঠাকুর্দাকে দেন। অন্যগুলো বেঁচেছিল কি না জানি না, তবে এটা দিব্যি বেঁচে আছে।”
আমি বললুম, “কঙ্গো তো ছিল বেলজিয়ানদেব দখলে।
ভাদুড়িমশাই বললেন, “সবটা নয়। খানিকটাতে ফরাসি শাসন চলত। মিডল কঙ্গো, গ্যাবন আর উবাঙ্গি শারি–এই তিনটে জায়গা নিয়ে যে এলাকা, তাকে বলা হত ফ্রেঞ্চ ইকুয়েটরিয়াল আফ্রিকা।…তো পরমেশ, এই বাড়িটা তো আরও পুরনো। কত হল এর বয়েস?”
“তা অন্তত শ দেড়েক বছর।” পরমেশ বললেন, “এক ফরাসি সাহেব তাঁর নিজের জন্যে বানিয়েছিলেন। তার কাছ থেকে আমব ঠাকুর্দা যখন কেনেন, শুনেছি তখনই এই বাড়ির বয়েস নাকি পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে।“
একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন পরমেশ চৌধুরি। তারপর বললেন, “হুট করে এই বাডি কি বেচে দেওয়া যায়? এর সঙ্গে কত স্মৃতি জড়িয়ে বয়েছে। আমার ঠাকুর্দা আর ঠাকুমার স্মৃতি, আমার বাবা আর মায়ের স্মৃতি, আমার নিজের গোটা জীবনের স্মৃতি। জাকারান্ডা গাছটা তো আমার ঠাকুর্দার লাগানো। বাড়ির পিছনে একটি মস্ত ছাতিম গাছ রয়েছে, সেটা লাগিয়েছিলেন আমার বাবা। আর সামনের গেটের দু’পারে যে দুটি গোলমাথা বকুল গাছ দেখছ, এই দুটিই আমার মা লাগিয়েছিলেন। গাছগুলি দেখি, আর তাদের কথা মনে পড়ে। এ সব ছেড়ে আমি যাব কোথায়? আর তা ছাড়া, এই বাড়ি আর এই গাছপালার কথা যদি ছেড়েও দিই, এত চেনা লোকজনই বা কোথায় পাব? বলতে গেলে এখানকার প্রায় প্রত্যেকটি লোককে আমি চিনি।”
হঠাৎই একেবারে সরাসরি পরমেশের দিকে তাকালেন ভাদুড়িমশাই। তারপর বললেন, “বিমলভূষণ সেনকে চেনো?”
মনে হল পরমেশ একটু হকচকিয়ে গেছে। ভুরু কুঁচকে বললেন, “কোন বিমলভূষণ? মন্দিরবাড়ির?”
“হ্যাঁ। যে মন্দিরে হরপার্বতীর মূর্তি রয়েছে। দু’জনেরই থার্ড আই নাকি হিরের। সত্যি?”
“সত্যি।” পরমেশ বললেন, “শুনেছি বিমলভূষণের গ্রেট গ্র্যান্ডফাদার ওই হিরেজোড়া নাকি এক গুজরাটি ব্যবসায়ীর কাছ থেকে কিনেছিলেন। কিন্তু হরসূন্দরবাবু সেকথা বিশ্বাস করেন না।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “কে হরসুন্দরবাবু?”
“হরসুন্দর মুখুটি। বয়েস বিরানব্বই। বলতে গেলে এই চন্নননগরের গেজেট।” পরমেশ বললেন, “তার কাছে পাবে না, এমন খবর নেই।”
ভাদুড়িমশাইয়ের চোখ দেখলুম সরু হয়ে এসেছে। বললেন, “ভদ্রলোকের সঙ্গে একবার দেখা করা যায়?”
“বিলক্ষণ। তবে তিনি এখানে থাকেন না।”
“তা হলে কোথায় থাকেন?”
“দূরে নয়,” পরমেশ চৌধুরি হাত তুলে আশ্বাস দিয়ে বললেন, “খুবই কাছে। গড় পেরিয়ে ভদ্রেশ্বরে ঢুকে খানিক এগিয়ে ডাইনে একটা গলি। গলি ধরে এই ধরো মিনিট দুই-তিন হাঁটতে হবে, বাস।”
সদানন্দবাবু বললেন, “হাঁটতে হবে কেন?”
পরমেশ বললেন, “সরু গলি, গাড়ি ঢুকবে না। কী চারুদা, যাবে?”
“যাব তো অবশ্যই।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিন্তু কখন যাব।”
“যাওয়া তো এখুনি যায়।” পরমেশ বললেন, “কিন্তু আমি বলি কী, এই ভরদুপুরে গিয়ে কাজ নেই। বুড়ো এই সময়ে একটু জিরিয়ে নেয়। তা সেও জিরোক, তোমরাও খেয়েদেয়ে একটু জিরিয়ে নাও, তারপর এই ধরো চারটে নাগাদ বেরিয়ে পড়া যাবে। রাজি?”
“রাজি।”
.
॥ ৫ ॥
বিকেল চারটেতেই বেরিয়ে পড়া গেল। মারুতি এইট হান্ড্রেডের পিছনের সিটে তিনজন বসলে বড্ড ঠেলাঠেসি করে বসতে হয়, কিন্তু উপায় কী, আমি সদানন্দবাবু আর কৌশিক তা-ই বসলুম। সামনে স্টিয়ারিং হুইলের সামনে ভাদুড়িমশাই, তার পাশের আসনে পরমেশ চৌধুরি।
দুর্গ থাকলে তাকে ঘিরে একটা পরিখা থাকবে, এ খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু যেমন কলকাতার ক্ষেত্রে, তেমনি চন্দননগরের ক্ষেত্রেও গোটা শহর একটা পরিখা দিয়ে ঘেরা। কলকাতাকে গড়খাই দিয়ে ঘেরা হয়েছিল বাইরের শত্রুদের মূলত বর্গিদস্যুদের— হানাদারি ঠেকাবার জন্য। মারাঠা ডিচ নামটাই তার প্রমাণ। চন্দননগরের এই গড়খাইয়ের বয়েসও নেহাত কম হল না। পরে নানা সময়ে এর সংস্কার হয়ে থাকতে পারে, তবে এটি প্রথম কাটা হয়েছিল নাকি ১৬৭৬ সালে। শহরের তিনশো বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত একটি স্মারক পুস্তিকায় অন্তত এইরকমই দেখছি।
যা-ই হোক, গড়খাই পেরিয়ে আরও খানিকটা গিয়ে বড়রাস্তার ধারে আমাদের গাড়ি পার্ক করা হল। পরমেশ বললেন, “এবারে আমরা ডানদিকের গলিতে ঢুকব। কিন্তু তার আগে একটা কথা বলে রাখি, চারুদা।”