- বইয়ের নামঃ ভাদুড়ি সমগ্র
- লেখকের নামঃ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
- প্রকাশনাঃ দে’জ পাবলিশিং (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
বিগ্রহের চোখ
বিগ্রহের চোখ – গোয়েন্দা ভাদুড়িমশাই – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
আজ এগারোই এপ্রিল, রবিবার। কৌশিককে সঙ্গে নিয়ে ভাদুড়িমশাই একটা তদন্তের কাজে বাঙ্গালোর থেকে দিন কয়েকের জন্য কলকাতায় এসেছেন। ফলে অরুণ স্যানালের কাকুড়গাছির ফ্ল্যাটে আজ ছুটির দিনের আজ্ঞা একেবারে জমজমাট। ঘড়িতে এখন সকাল দশটা বাজে। কিন্তু দুপুরের খাওয়াটা যেহেতু আমরা আজ এখানেই সেরে নেব, তাই আমারও বাড়ি ফেরার তাড়া নেই, সদানন্দবাবুরও না। তার উপরে আবার গতকাল রাত্তিরে যখন ভাদুড়িমশাইয়ের সঙ্গে টেলিফোনে আমাদের কথা হয়, সদানন্দবাবু তখন তাকে মনে করিয়ে দিতে ভোলননি যে, বাংলা বছরের এটাই হচ্ছে লাস্ট সানডে। কথাটার মধ্যে যে একটা গূঢ় ইঙ্গিত ছিল, ভাদুড়িমশা, সেটা ধরতে পেরেছে ঠিকই, তা নইলে আর টেলিফোনের মধ্যেও অমন হোহো করে তিনি হাসতে থাকবেন কেন? সুতরাং আশা করা যাচ্ছে যে, আজকের দ্বিপ্রহরিক খাওয়াটা বেশ ঢালাও রকমেরই হবে।
আড্ডা জমে যাবার অবশ্য আরও দুটো কারণ আছে। তার মধ্যে প্রথম কারণ হল, কৌশিকের চোখ এই সময় টিভির পর্দায় টি, এ. টির কার্টুন পিকচার্সে আটকে থাকার কথা, কিন্তু কলকাতার কেবল অপারেটররা যে-সব পে-চ্যানেলের ছবি দেখানো বন্ধ করে দিয়েছে, তার একটা হচ্ছে টি.এন.টি। কৌশিকও তাই টেলিভিশনের সুইচ অন করেনি, এবং কার্টুন ছবির হুল্লোড় বন্ধ থাকায় একদিকে যেমন শব্দ দূষণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া গেছে, অন্যদিকে তেমনি আমাদের আড্ডাতেও কোনও ব্যাঘাতের সৃষ্টি হচ্ছে না। আর দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে সদানন্দবাবুর গল্প। গল্পটা ক্রমে-ক্রমে যেদিকে মোড় নিচ্ছে, তাতে মনে হয়, খুব শিগগিরই একটা রোমহর্ষক ঘটনা ঘটবে।
ঘটলও। সদানন্দবাবু বললেন, “আপনাদের আমি অনেক দিন ধরে দেকচি তো, যেমন কিরণবাবু, তেমনি এ-বাড়িরও কাউকে চিনতে আমার বাকি নেই, তেলপড়া, জলপড়া, তুকতাক, ঝাড়ফুক, বাটি চালান, ক্ষুর চালান কি ওই রকমের কিছুই যে আপনারা বিশ্বেস করেন না, মুক টিপে হাসেন আর মনে-মনে আমাকে একটা ড্যাম লায়ার ভাবেন, সে আমি খুব ভালই জানি। কিন্তু আমি তো নিজের চোকে দেকিচি, তাই কী করে অবিশেস করব বলুন?”
অরুণ সান্যাল বললেন, “আহা-হা, কী হল বলুন না, বাটিটা একটা ফ্লাইং সসার হয়ে আকাশে উড়ে গেল?”
“তা কেন উড়বে?” সদানন্দবাবু বললেন, “না না, তা ওড়েনি, কিন্তু যা হল, সেও চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। এই দেকুন, আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। বাটিটা তো এতক্ষণ নীলকণ্ঠ ঘোষের উঠোনের ওপরে একটা জিগজ্যাগ কোর্সে ঘোরাফেরা করছিল, হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই, দুম করে একেবারে….ওরে বাবা রে বাবা, সে এক বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড মশাই….ওই যাকে আপনারা বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা হয় না বলেন আর কী, সেই রকমের আনবিলিভেবল ইনসিডেন্ট!”
ভাদুড়িমশাই মিটিমিটি হাসছিলেন। বললেন, “খেলে যা! কী হল, সেইটে বলুন দেখি।”
“বলচি, বলছি।” সদানন্দবাবু বললেন, “বেন্দাবন মাঝির যে বাটি এতক্ষণ নীলকণ্ঠ ঘোষের কাঁচারি-ঘরের সামনেকার উঠোনের উপর হরাইজন্টালি ঘোরাফেরা করছিল, সেটা হঠাৎ ভার্টিক্যালি মাটির থেকে তা ধরুন দু-আড়াই ফুট নাপিয়ে উটে অ্যাব্রাগুলি একটা টার্ন নিয়ে কোতায় গিয়ে আটকে গেল জানেন?”
কৌশিকের চোখ দুটো দেখে মনে হচ্ছিল, কোটর থেকে যে-কোনও মুহূর্তে তারা বেরিয়ে আসবে। সোফা থেকে একটুখানি সামনে ঝুঁকে ঘড়ঘড়ে গলায় সে জিজ্ঞেস করল, “কোথায়?”
“নীলকণ্ঠের বুড়ি-শাশুড়ির মাজায়!”
“অ্যাঁ?” অরুণ সান্যাল প্রায় আঁতকে উঠে বললেন, “বাটিটা আর জায়গা পেল না? অব অল প্লেসেস…”
সদানন্দবাবু বললেন, “ইয়েস, মাজা! কী বলব মশাই, বুড়ি তো হাউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠল! কিন্তু যতই না কেন চেঁচাক, আর মাজা থেকে ঝেড়ে ফেলার জন্যে টানা হাচড়া করুক, বাটি আর খোলে না! খুলবে কী করে, এ হল গে বেন্দাবন মাঝির বাটি! দশ-দশখানা গায়ের মধ্যে অমন গুনিন তো দুটি নেই! মন্তর পড়ে দিয়ে চালান করেছে কিনা, তাই চোরের মাজায় একেবারে জম্পেশ হয়ে সেঁটে আচ্চে। তো এই হচ্ছে ব্যাপার?”
কৌশিক বলল, “তার মানে নীলকণ্ঠ ঘোষের সোনা-বাঁধানো নস্যির ডিবে তার শাশুড়িই চুরি করেছিল?”
“তা করেছিল বই কী।“ সদানন্দবাবু বললেন, “অতি ধুরন্ধর জাঁহাবাজ মহিলা! তার উপরে ক্লিপ…ক্লিপ…ওই যে কী একটা কতা রয়েছে…”
“ক্লেপটোম্যানিয়াক?”
“রাইট! যেখেনেই যাক, হাতের কাঁচে দামি কিছু পেলেই হল, হাপিস করে দেবে।”
“নীলকণ্ঠ ঘোষ তা জানত।”
“অফ কোর্স জানত।” সদানন্দবাবু বললেন, “কিন্তু তার বউ সেকতা বিশ্বেস করত । বলত, ছিছি, মেয়ে-জামাইকে ভালবাসেন বলে বরাবরের জন্যে বেড়াতে এয়েছেন, আর তার নামে কিনা যা-তা সব বলচ। নীলকণ্ঠও এই নিয়ে আর কতা বাড়ায়নি। কিন্তু শেষকালে নস্যির ডিবে চুরি যেতে সে আর চুপ করে থাকতে পারল না….বেন্দাবনকে ডেকে পাটাল।”
অরুণ সান্যাল বললেন, “তা উদ্ধার হল সেই নস্যির ডিবে?”
সদানন্দবাবু বললেন, “হল বই কী, বাটি যেখেনে আটকে গে, সেখেন থেকেই হল। বুড়ির মাজায় ছিল থান-কাপড়ের কষির গিট, সেই গিঁটের ভেতর থেকেই নস্যির ডিবে বেরিয়ে পড়ল। সোনার পাতে মোড়া কষ্টিপাথরের ডিবে, তার ডালায় আবার পায়রার চোকের মতো টকটকে লাল চুনি বসানো, সে মানে দ্যাকবার মতো জিনিস।”