জগতের সমস্ত বাঘ, সমস্ত সাপ, আর সমস্ত চোর-ডাকাত খুনেগুণ্ডা বুঝি সোনালীর গাড়িখানা ঘিরে তাণ্ডবনৃত্য করছে, শুধু একবার ঝাঁপিয়ে পড়বার ওয়াস্তা।
যা থাকে কপালে বলে আর বসে থাকা অসম্ভব! সহসা একটা কাজ করল সোনালী। গাড়ির হেলাইটটা ফের জ্বালিয়ে তীব্র শব্দে হর্ণটা বাজাতে শুরু করল। মুহুর্মুহু নয়, অনবরত।
অবিচ্ছেদ্য সেই তীক্ষ্ণ তীব্র চীৎকারটা যেন খণ্ড বিখণ্ড করতে চাইছে গ্রামের নিশ্চিন্ত শান্তি।
কিন্তু সোনালীরও যেন নেশা লেগেছে। যেন বাজিয়ে যাবেই শেষ পর্যন্ত, যতক্ষণ ওই যন্ত্রটার ক্ষমতা থাকবে আর্তনাদ করবার। অথবা ওই শব্দটার মধ্যেই বুঝি ভরসা খুঁজছে সে।
সামনের পথটা গাড়ির আলোয় চোখধাঁধানো, কিন্তু পাশের অন্ধকার অনাহত।
.
হঠাৎ যেন বিদীর্ণ হল সেই নিচ্ছিদ্র প্রাচীর। সরু একটি আলোকরেখা কোথায় যেন চিকচিকিয়ে উঠল।
সত্যি? না কল্পনা?
কিসের ওই আলোকরেখা, দুলছে কাঁপছে, মাঝে মাঝে স্পষ্ট হয়ে উঠছে, মাঝে মাঝে মিলিয়ে যাচ্ছে? কিসের আলো ওটা?
চিরশহরবাসিনী সোনালী গল্পে কাহিনীতে পড়া ধারণাটাকে ছুটিয়ে দেয় কল্পনার ঘোড়ায় চড়িয়ে।
ওই বোধহয় আলেয়া।
ওই যে মাঝে মাঝে স্পষ্ট হচ্ছে, মাঝে মাঝে মিলিয়ে যাচ্ছে। ওই আলেয়াটাই কি সোনালীকে পথভ্রান্ত করে দেবে?
কিন্তু কি করে? সোনালী তো গা থেকে নামছে না। ওর পিছনে ছুটতেও যাচ্ছে না।
কিন্তু কিসের পিছনে ছুটে এতদূর এল সে?
আর যদিই বা উগ্ৰ অভিমানের বশে এসে থাকে, প্রধান রাস্তাটা ছেড়ে এমন অজানা অন্ধকার কাঁচা রাস্তায় চলে এল কেন?
যশোর রোড দিয়ে অনবরত মালবাহী লরি আসা যাওয়া করে। সোনালীর অচল গাড়িখানা সেখানে পথ জুড়ে পড়ে থাকলে নিশ্চয় তাদের দৃষ্টিতে পড়ত, এবং এতক্ষণে নীপার বাড়ি বসে সমারোহ করে নিজের খামখেয়ালের অ্যাডভেঞ্চারের গল্প করতে পারত সোনালী।
কিন্তু তা হল না। পাকা রাস্তা ছেড়ে কাঁচা রাস্তায় চলে এসেছে সোনালী।
হয়তো বা শুধু এইটুকু চলে আসার জন্যেই জীবনের পাকা রাস্তাটাকে হারালো সোনালী। চিরকালের মত কাঁচা রাস্তায় পড়ল।
না, ওটা আলেয়া নয়, লণ্ঠনের আলো। কেউ বুঝি এগিয়ে আসছে আলোটা হাতে ঝুলিয়ে।
ছেলেবেলায় শোনা যত সব ডাকাতের গল্প মনে জেগে উঠছে। আলো হাতে করে কাছে আসে তারা, কড়া গলায় বলে, গায়ে কী গহনা আছে খুলে দাও চটপট।
কিন্তু শুধু গহনা পেলেই কি সন্তুষ্ট হয়ে চলে যাবে?
তাই কি যায়? যদি আরও কিছু উপরি পাওনার আশা থাকে? হায় হায়, কেন এ বোকামী করতে গেল সোনালী? কেন শব্দের সঙ্কেত দিয়ে অনিশ্চিত বিপদকে নিশ্চিত করে তুলল? কেন আলোর নিশানা দিয়ে জানিয়ে দিল কোনখানটায় পড়ে আছে সে অরক্ষিত একটা গাড়ির মধ্যে?
আলোটা ক্রমশ এগিয়ে আসছে।
আর বোঝা না বোঝার দ্বন্দ্ব নেই। দুটো লোক আসছে গাড়ির দিকে। একজনের হাতে একটা হ্যারিকেন লণ্ঠন। মেঠো লোক, গায়ে জামার বালাই নেই, কেঁচার খুঁটটা একটু গায়ে দেওয়া।
দুজন এসেছে, অর্থাৎ গুছিয়েই এসেছে। কে জানে হাতের ফাঁকে লুকোনো আছে কিনা কোনও ধারালো অস্ত্র।
বাইরে থেকে ভরসার যখন আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না, ভয় বস্তুটা একটা ক্ষুধার্ত হিংস্র জন্তুর মত দন্ত মেলে উদ্যত হয়ে ওঠে, তখনই বুঝি অন্তর্জগতে একটা ওলটপালট ঘটে যায়। চিরদিনের ভীতু মানুষটা সহসা সাহসী হয়ে ওঠে, চিরদিনের দুর্বল মানুষটা পায় অমিত বল। মন যেন তার আঁকড়ে ধরে থাকা কোনোখানে লুকিয়ে রাখা শেষ ব্রহ্মাস্ত্রখানা প্রয়োজন বুঝে বার করে।
.
ওরা গাড়ির কাছে এসে পড়েছে।
হাতের কাছে কোনও ভারী জিনিস থাকলে, ঈশ্বর জানেন সেইটা ছুঁড়ে মেরে বসত কিনা সোনালী। কিন্তু কিছুই নেই। একখানা ভারী বই পর্যন্ত না।
অতএব চীৎকার নয়, অদৃশ্য কারও কাছে সাহায্য প্রার্থনা নয়, শুধু সমস্ত মানসিকশক্তি একত্র করে বসে বসে প্রতিক্ষা করা মৃত্যুর জন্যে, ধ্বংসের জন্যে।
.
কিন্তু কই, ওরা তো এসেই গাড়ির দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে বসল না। জানালার কাঁচগুলো শাবলের ধাক্কায় ভেঙে সাতটুকরো করল না! ওরা শুধু হাতের আলোটা তুলে ধরে কিছু একটা প্রশ্ন করল।
কাঁচের ওপিঠ থেকে গলার আওয়াজ ঠিক বোঝা গেল না, তবে ভঙ্গীটা বোঝা গেল– প্রশ্নের ভঙ্গী।
আশ্চর্য, একটা ভদ্রলোক জুটল না সোনালীর ভাগ্যে?
তবু দরজাটা খুলল সোনালী।
আর তীব্র তীক্ষ্ণকণ্ঠে এমনভাবে প্রশ্ন করল যেন ওরা কাঠগড়ার আসামী, আর নিজে সে অপর পক্ষের উকিল।
জায়গাটার নাম কি?
হ্যারিকেনধারী চুপচাপ সেটা উঁচু করে তুলেই রইল। অপর ব্যক্তি মৃদুস্বরে উত্তর দিল, এই পাড়াটাকে জামতলা বলা হয়। টাউন বনগাঁ।
বনগাঁ! কী সর্বনাশ! বনগাঁ পর্যন্ত চলে এসেছে সোনালী? কিন্তু আসা তো নয়, এ যে এসে পড়া!
কে জানে এই এসে পড়তে কতক্ষণ লেগেছে?
কিন্তু না, এদের সামনে বিচলিত ভাব দেখালে চলবে না, ভুরু দুটো আরও কুঁচকে বলে ওঠে, বেজেছে কটা?
এই খালি-গা চাষা দুটোকে আপনি বলতেও ইচ্ছে করছে না, আবার ঠিক তুমিটাও মুখে আসছে না। একটা লোক যেন ঠিক চাষার মতও নয়। যদিও বেশভূষায় উভয়েই প্রায় অভিন্ন, তবু কোথায় যেন মস্ত একটা পার্থক্য রয়েছে চোখে, চুলে, মুখের রেখায়। হ্যারিকেনের আলোটা ওর মুখেই বারেবারে আলোছায়ার আলপনা কাটছে।